আমার মা : কণ্ঠশিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমীন
তারিফ হায়াত খান
বড় ছেলে ড: তারিফ হায়াত খান-এর লেখনীতে প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমীনের জীবন কথা
ভূমিকা
নানা লেখাপড়ায় ছিলেন চৌকশ। বিএ পাশ করে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের বিসিএস (বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়ে সার্কেল অফিসার হিসাবে কলকাতায় কাজ শুরু করেন ১৯৩৮ সালে। সরকার থেকে বরাদ্দ ছিলো একটা খাকি হাফপ্যান্ট আর একটা নতুন সাইকেল। সাইকেলে করে সেই খাকি হাফপ্যান্ট পরে অফিসে যেতেন নানা। মেসে থাকতেন। একই মেসে থাকতেন আমার নানীর আপন মামা। নানা তার একজন পছন্দের লোক ছিলেন। নিজের ভাগ্নীর কথা চিন্তা করে নিজেই ঘটকালী করে নানাকে ভাগ্নীর সাথে বিয়ের প্রস্তাবটা দেন। নানার বাবা মারা গেছেন বহু আগেই। মা ছিলেন দেশের বাড়িতে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে নানা চতুর্থ। খুব কাছাকাছি মুরুব্বী মানে নানার বড় ভাই। তিনি উতসাহ দেখালেন। আমার মায়ের সেই নানার সাথে মা-র চাচা মেয়ে দেখতে আসলেন। তখন ছেলে সাথে যাওয়ার তেমন প্রচলন ছিলোনা। তবে আমার নানা বলে দিয়েছিলেন বড় ভাইয়ের পছন্দ হলে তার কোন আপত্তি থাকবেনা। নির্ধারিত দিনে তারা এসে গেলেন মায়ের নানার বাসায়। কথাবার্তা হলো, খাওয়া দাওয়া হলো। নানীর মামা মানে মায়ের সেই নানা জানিয়ে দিলেন মেয়ে ভালো গান গায়। শুনে নানার বড়ভাই খুব খুশী। তার বাসায়ও গান গাওয়ার পরিবেশ আছে। বললেন তাহলে একটা গান শুনি। মেয়ের তো অপরিচিত ছেলেদের সামনে আসার চল নাই। আমার নানী পাশের ঘর থেকেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটা গান শোনালেন। নানার ভাই গান শুনে মহা খুশী। বিদায় নিতে উঠলেন। মায়ের নানা বললেন মেয়ের গায়ের রঙ, চেহারা বা এই সব বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলেন না? মায়ের চাচা বললেন, গান শুনেছি, তাতেই আমি রাজী। আর কিছু জানা লাগবে না। তবে সম্ভব হলে আরেকটা গান শুনে যেতে পারি। ভিতরে অনুরোধ চলে গেলো। নানী আরেকটা গান গেয়ে শোনালেন পাশের ঘর থেকে। খুশী মনে মা-র চাচা চলে গেলেন। নানাকে জানিয়ে দিলেন তিনি রাজী। নানাও রাজী। বিয়ে হয়ে গেলো আমার নানা এবং নানীর মধ্যে। আমার এই নানীই আমাদের দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে স্বনামধন্য ইয়াসমিন বোনদের রত্নগর্ভা মা। গান গেয়ে দেশে পরিচিতি ও সম্মান পেয়েছেন আমার বড় খালা ফরিদা ইয়াসমীন, আমার মা ফওজিয়া ইয়াসমীন, চতুর্থ বোন নীলুফার ইয়াসমীন, এবং সবচেয়ে ছোট আমাদের গানের জগতের কিংবদন্তী সাবিনা ইয়াসমিন। নানা লুতফর রহমান এবং নানী মওলুদা খাতুন।
প্রথম পর্ব: শৈশব ও কৈশোর
বাল্যকাল
১৯৩৮ সালের এই ঘটনার সময় আমার নানীর বয়স ছিলো মাত্র চৌদ্দ কি পনেরো। এর কিছুদিন পরেই নানা-নানীর বিয়ে হয়ে যায়। বদলীর চাকরী হওয়ায় কলকাতা এবং কলকাতার আশেপাশে ১৯৩৮-১৯৪৭ পর্যন্ত এই নয় বছরে পাঁচটা বাসায় ছিলেন নানা-নানী। পার্ক সার্কাস এবং পার্ক স্ট্রীট কলকাতা শহরের ভিতরে হলেও শিউড়ী, ডায়মন্ড হারবার, আর বীরভূমে বদলির সময় সেই শহরগুলোতে মায়েদের যেতে হয়। ততদিনে নানার তিন সন্তানের জন্ম হয়ে গেছে। বিয়ের বছর দুইয়ের মধ্যেই জন্ম নেন প্রথম সন্তান আমার বড় খালা ফরিদা ইয়াসমিন, তার একবছর পরে দ্বিতীয় সন্তান আমার মা ফওজিয়া ইয়াসমিন, আর তার দুই বছর পরে তৃতীয় সন্তান আমার সেজ খালা নাজমা ইয়াসমিন। আমার মায়ের মতে নানার সংসারের সবচাইতে সুখের সময় এই নয়টা বছর, যাকে বলা যেতে পারে ‘গোল্ডেন পিরিয়ড’। ’৪৮ এর শুরুতে মা এবং বড় খালা প্রথমবারের মতো স্কুলে যাওয়া শুরু করলেন। কোলকাতার রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল ইংলিশ মিডিয়াম কিন্ডারগার্টেনে শুরু হলো তাদের লেখাপড়া।
তবে এখানে উনারা মাত্র কয়েক মাসই পড়তে পেরেছিলেন। দেশ ভাগের পরপর চারিদিকেই একটা অস্থিরতা। নানাকে কলকাতার একজন ব্যবসায়ী বন্ধু ভয় দেখালো মুসলমান-হিন্দু সমস্যার জন্য চাকরী কি আর বেশীদিন থাকবে? আর থাকলেও সরকারী চাকরী করে কি করে তিন সন্তানের সংসার ভালোমত চালাবে, তার চেয়ে ব্যবসায়ে অনেক টাকা আসবে। কিভাবে কি হলো, নানা কনভিন্সড হয়ে গেলেন। যে মানুষটা লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই করতে মজা পান না, সরকারী সুন্দর একটা স্থায়ী চাকরীও জুটে গেছে, হোক সে খুব আহামরী কিছু উপার্জন হয়তো না, কিন্তু ভবিষ্যত যেখানে নিশ্চিত, সেই মানুষটি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেললেন একজন অসৎ লোকের ফাঁদে পড়ে। নানী অনেক বলেছিলেন, নানা শোনেননি। কি করে যেন মোহটা কাটাতে পারলেননা, নিজের যা আছে সম্পত্তি, সব বেচে ব্যবসার মূলধনের নামে নগদে সেই লোককে দিয়ে চাকরীর পদত্যাগপত্র জমা দিলেন। তখন ডেপুটি সেক্রেটারী যার কাছে পদত্যাগপত্র দিতে হবে উনি তারই আপন ভাই। উনি কিছুতেই পদত্যাগপত্র জমা নেবেননা। যদি নানার মত পরিবর্তন হয়। দুইদিন, তিনদিন চলে গেলো, নানাকে বোঝালেন এই ভুলটি যেন না করেন। তার মতো একজন স্কলারের ব্যবসায়ে যাওয়াটা বোকামী। কিন্তু নানাকে তখন গোয়ার্তুমীতে পেয়ে বসেছে। কারো কথা শুনলেন না। দেশ ভাগ হয়ে গেলো, আর নানার সেই পার্টনার সব টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেলো নানাকে একেবারে পথে বসিয়ে। সেদিন থেকে শুরু হলো নানার অনিশ্চিত জীবন।
ব্যবসার ব-ও যিনি বোঝেননা তার জন্য এটাই স্বাভাবিক পরিনতি ছিলো। কিন্তু সেই সুন্দর নিশ্চিন্তের চাকরী কি আর ফিরে পাওয়া যায়? আয়-রোজগার ছাড়া অবস্থায় বাসা ভাড়া কুলাতে না পেরে নানী এবং তিন মেয়েকে শ্বশুড়বাড়িতে রেখে নিজে মেসে থেকে চাকরীর চেষ্টা করবেন ঠিক করলেন। এমনিতে আমার নানী প্রতিবারই সন্তানসম্ভবা অবস্থায় শেষদিকে চলে যেতেন তার বাবা, অর্থাৎ আমার মায়ের নানার বাসায়। বাচ্চার জন্মের পর কয়েক মাস আমার নানী তার মায়ের বাসায় কাটিয়ে আবার কলকাতায় চলে যেতেন। তাই নানাবাড়ী আমার মা-খালার জন্য নতুন কিছু না। সেই বাসার বিরাট বড় আঙ্গিনায় ছড়ানো ছিটানো বিশাল বৈঠকখানা, অন্দরমহল, রান্নাঘর, বাথরুম। আনন্দের সাথেই তিনবোন মায়ের সাথে নানাবাড়ী থেকে যাবার প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু ততদিনে পট পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেশভাগের সময় যখন হিন্দু আর মুসলিম সম্পত্তি বদলা-বদলি হচ্ছিলো, আমার মায়ের নানা রাজশাহীতে একজন হিন্দুর সাথে সম্পত্তি বদলালেন। মোটামুটি ভালোই ঠকে গেলেন বলা চলে। সাইজে অর্ধেকেরও বেশী ছোট একটি বাসা পেলেন তারা। মাটির উঠোন বলতে কিছু নেই, যেটুকু আছে সেটুকু পাকা। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। তাড়াহুড়োর মধ্যে যতটুকু পাওয়া গেছে সেটাকেই ভাগ্য মেনে নিয়ে আম্মার নানা সেই বাসায় চলে এসেছিলেন। এরপর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নানা প্রাইভেট চাকরী পেয়ে বাসা ভাড়া করে আবার পরিবার কলকাতায় নিয়ে আসলেন। ভাবছেন সমস্যাতো মিটলো, আবার সুখের সংসার। কিন্তু সেটা হবার নয়। নানা চাকরী হারালেন কয়েক মাসের মধ্যেই। আবার পরিবার নানাবাড়ীতে পাঠানো, আবার উনার মেসে থাকা। নানা আবার চাকরী জোগাড় করলেন, আগের মতোই পরিবার আনলেন, এবং ঠিক আগের মতোই কিছুদিনের মধ্যেই চাকরী হারালেন। এরই মধ্যে এটা যেনো একটা প্যাটার্ণ হয়ে গেলো। নানা কোন চাকরীতেই বেশীদিন থাকতে পারছেন না দেশবিভাগ পরবর্তী নানা অস্থিরতার কারনে। কোন সময় কোম্পানী উঠে যায়, বা কখনো নানাই আর তাদের সাথে বনিবনা করতে পারেননা। কিন্তু নানা কেমন কেমন করে আবার চাকরী জুটাচ্ছেন, আবার পরিবার কলকাতায়, আবার চাকরী চলে যাচ্ছে, আবার মায়েরা নানাবাড়ি। কিন্তু এইভাবে কি অনির্দিষ্ট কাল ধরে চালানো যায়? এরই মধ্যে এসে গেছে চতুর্থ সন্তান, পরবর্তীতে স্বনামধন্য নজরুল ও উচ্চাংগ সংগীতশিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন।
এদিকে এতবার নানাবাড়ী থাকার মধ্যে একটা জিনিষ পরিষ্কার হলো। দেখা গেলো বড় বোন বা সেজো বোনের চেয়ে আমার মায়ের ঘরের কাজের দিকে নেক একটু বেশী। নানার প্রিয়পাত্র হয়ে গেলেন আমার মা। এতটাই প্রিয় যে ১৯৪৯ সালের শেষে নানা যখন আরেকবারের মতো পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় মা-কে নানা রেখে দিতে চাইলেন নিজের কাছে। তখন মায়ের মাত্র ক্লাস থ্রি-এর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। খেলার সাথী হিসেবে প্রায় সমবয়সী দুই খালাকে পেলেন, আমার ভুলু নানী আর টুলু নানী। এদের সাথে আগেও ছিলেন, কিন্তু তখন নিজের বোনেরাও থাকতো। এবার বোনেরা নাই, তাই খালারাই হয়ে গেলেন খেলার সঙ্গী।
ক্লাস ফোর শুরু হলো। ক্লাসের সময় ক্লাস, তারপর সন্ধ্যায় পড়াশোনা, খালাদের সাথে খেলা, নানার ফাই-ফরমাশ খাটা আর নানীকে সংসারের কাজে সাহায্য করা। এই শেষের কাজটা মায়ের এমনিতেই প্রিয় ছিলো, এখন আরো প্রিয় হয়ে উঠলো। আবার মা-ও হয়ে গেলেন নানা আর নানীর আরও প্রিয়। আজ জীবনের এতোটা পথ পাড়ি দিয়েও আমার মা এখনও প্রতিটি দিনের জীবনীশক্তি পান সংসারের কাজগুলো নিজের হাতে করেই।
‘৪৯ সালটা কি করে যেনো মোটামুটি ভালো কেটে গেলো নানার। নানীকে এর মধ্যে আর তার বাবার বাসায় আসতে হয়নি। কিন্তু বছর শেষের বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই নানা চলে আসলেন মা-কে নিয়ে যেতে। আবার মা চলে আসলেন তার বাবামায়ের কাছে।
এদিকে নানা এতো রকম অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে থাকলেও এতোদিন পর্যন্ত কলকাতাতেই থেকে যাবার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। কিন্তু মেয়েরা বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে, উনি বুঝতে পারলেন যে ঢাকাতেই শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি নানা সপরিবারে ঢাকা চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার নানীর বাবা তখনো রাজশাহীর মালোপাড়ার বাসাতে। তাকে না জানিয়েই ঢাকায় এসে পুরনো ঢাকার ‘ঢাকা বোর্ডিং’-এ উঠলেন। খবর কোনভাবে চলে গেছিলো নানীর ভাইয়ের কাছে। তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। তিনি থাকতে বোন-কে সপরিবারে কেন বোর্ডিং এ থাকতে হবে? তার ছোটো বোন (আমার নানী) যে ছিলেন তার খুবই প্রিয়। আমার নানীর বাবাও ল’ইয়ার ছিলেন। তিনি দীর্ঘজীবি ছিলেন। উনি বাংলা ১৩০০ সালে জন্মেছিলেন, তাই সালের সাথে সাথেই তাঁর বয়স চলতো। তবে তাঁর গল্প অন্যত্র হবে। আপাতত নানার গল্পে যাই। আমার সেই বড়োবাবা (নানীর বাবা)-র পরামর্শমতে আমার নানীর বড় এবং একমাত্র ভাই, উনি এসে নানা-নানীকে পুরানো ঢাকায় তার পাতলা খান লেনের বাসায় নিয়ে গেলেন। নানা তখন ছোট একটা চাকরী করছিলেন। সম্বন্ধীর বাসায় নানা সপরিবারে ছিলেন প্রায় এক বছর। এর পরপরই নানা আসলেই একটা ভালো চাকরী পেয়ে গেলেন এবার। চিত্তরঞ্জন কটন মিলে ওয়েলফেয়ার অফিসার। এটাকে বলা যেতে পারে ‘গোল্ডেন পিরিয়ড – ২’। ’৫১-’৫৪ এই চারটা বছর সুন্দর একটা সুস্থির জীবন আসলো। ফুলটাইমের পাশাপাশি নানা একটা পার্টটাইম চাকরীতেও ছিলেন। মায়ের জানামতে এই সময়েই নানা মেয়েদের জন্য বেশ কিছু গয়নাগাঁটি বানিয়ে দিতে পেরেছিলেন, যা তাঁরা সারাজীবনে যত্ন করে রেখেছিলেন।
কৈশোর
মায়েরা তিনবোন ভর্তি হলেন নারীশিক্ষা মন্দির স্কুলে। বড়ো খালা আর মা একই ক্লাসে পড়তেন, এবং সেজো খালা এক ক্লাস নীচে। এখানে মায়ের ক্লাস ফাইভ, সিক্স, সেভেন আর এইট শেষ হলো। এবার গন্তব্য ঢাকেশ্বরী কটন মিলস গার্লস হাই স্কুলে। এটা শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে। এদিকে বাসা এপারে। নানা অফিস থেকে স্পেশাল লঞ্চ পেলেন। বাসার থেকে কয়েক কদম দূরেই ঘাট। সেখানেই সকালে ছোট্ট লঞ্চটা এসে দাঁড়িয়ে থাকতো। মায়েরা তিনবোন লঞ্চে করে নদী পার হয়ে স্কুলে চলে যেতেন। আবার স্কুল শেষে সেই প্রাইভেট লঞ্চ আবার তাদেরকে নিয়ে বাসায় ফেরত দিয়ে যেতো। এটা মায়ের জীবনের অন্যতম সুন্দর স্মৃতি। এর মধ্যে আমার মায়েদের পঞ্চম এবং সবচেয়ে ছোট বোন দেশের স্বনামধন্য সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম হয়ে গেলো। ছোট দুইটা বোন মায়ের সাথেই সারাদিন কাটাতো, আর আম্মারা কাছাকাছি তিনবোন এক সঙ্গে চলতেন।
এসএসসিতে এসে পরীক্ষার সিট পড়লো নারায়ণগঞ্জেই মরগ্যান স্কুলে। এখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশনের ধাপ পেরোলেন মায়েরা বড় দুই বোন। ঐ যে তখন পুরো পরীক্ষা পাঁচ দিনে শেষ হয়ে যেতো, প্রতিটা দিন সকাল বিকাল দুটো করে পরপর পাঁচ দিন। সেটা ১৯৫৭ সাল। চিত্তরঞ্জন কটনমিলের চাকরীর কন্ট্র্যাক্ট শেষ করে নানা তখন নতুন চাকরীর সন্ধান করছেন। এদিকে মেয়েদের জন্য চলছে কলেজ খোঁজা। বাসার সবচেয়ে কাছে ছিলো সরকারী তোলারাম কলেজ, যদিও নদীর ওপারে। চাকরীর যেহেতু গ্যারান্টি পাওয়া খুব মুশকিল, বাসাও পাল্টাতে হতে পারে, তাই নানা প্রস্তাব দিলেন তোলারাম কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলে থাকার। কিন্তু মায়েরা দুই বোন হোস্টেলের ঘোর বিরোধী। দুই বোন প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর সময় প্ল্যান করেন কি করলে সবচেয়ে ভালো সমাধান পাওয়া যায়। একদিন তারা সত্যিই একটা পথ বের করলেন। মা চিন্তা করলেন নানাবাড়ীতে তো তার থাকার অভ্যাস আছেই, তাই উনি এইচএসসিটা উনাদের বাসায় থেকে করে ফেলতে পারেন। আর বড় খালা যেহেতু ঢাকাতেই থাকতে চান, তাই মায়ের বড় চাচা, যার কথা গল্পের শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম, তার বখশীবাজারের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতে পারেন, তাহলে নানাকে চাকরীর জন্য বাসা বদলাতে হলেও মায়েদের দুই বোনের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখাটা নির্বিঘ্নে চলতে পারে। এই বখশীবাজারের চাচার এক ছেলে আবার মনজুর হাসান মিন্টো, যিনি প্রথমে গোলরক্ষক, এবং পরে রেডিও টেলিভিশনের ক্রীড়াভাষ্যকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এদিকে এই পরিকল্পনার কথা মায়েরা দুই বোন আমার নানা-নানীকে বলাতে উনারাও রাজী হয়ে গেলেন এই ভেবে যে উনারা বাসা বদল করলেও মেয়েদের লেখাপড়াটা ঠিকমতো চলতে পারবে। অতঃপর দুই বোন দুই জায়গায় চলে গেলেন। মা রাজশাহীতে যেটা এখন রাজশাহী উইমেন’স কলেজ নামে পরিচিত, সেখানে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন।
দ্বিতীয় পর্ব: সংগীত জীবন
কলেজ জীবন
এই সময়টাই ছিলো মায়েদের জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। মায়েরা এতোদিন বাসাতেই আমার নানীর সাথে গান প্র্যাকটিস করতেন। ঐ যে বলেছিলাম নানী খুব সুন্দর গান গাইতেন। আশেপাশের লোকেরা জানতো এরা সুন্দর গান গায়। তবে পরিচিতি ওখানেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু কলেজ জীবনে ঢোকার পর কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দুই বোনই গাওয়া শুরু করাতে দেখা গেলো দুই জনই খুব কম সময়ের মধ্যেই কলেজের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন। একেবারেই ন্যচারাল ভয়েস ছিলো তাদের। যেটুকু শিখা মায়ের কাছেই।
পত্রপত্রিকা, চলচ্চিত্র, থিয়েটার, টিভি, রেডিও এবং এখনকার ইন্টারনেট, এগুলোই তো প্রচার মাধ্যম। রেডিও ছিলো তখন এক জনপ্রিয় প্রচার মাধ্যম। দেশবিভাগের আগে ১৯৩৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও চালু হয়। সেখানে ছিলো ভারতীয় শিল্পীদের আধিপত্য। দেশবিভাগের পর ১৯৪৭ সালে অদ্ভূত এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় দুইটি চরম ভিন্নধর্মী ভূ-সংস্কৃতির জাতিগোষ্ঠীকে একত্র করে পাকিস্তান গঠন করা হয়, যার পশ্চিম পাকিস্তান অংশ ছিলো এখনকার পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান ছিলো আমাদের বাংলাদেশ। তখন জন্ম হয় রেডিও পাকিস্তান। প্রায় ২,৫০০ কিমি দূরে অবস্থিত এই দুটো ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীকে এক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার মতো প্রহসনকে দূরে হটিয়ে অনেক দাম দিয়ে হলেও মাত্র চব্বিশ বছরেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আলাদা হয়ে যায় বাংলাদেশ। এই দুইটি অংশকে এক দেশ হিসাবে চিন্তা করা সব দিক দিয়েই অযৌক্তিক। পাকিস্তানীরাও সেটা জানতো। এবং জানতো বলেই প্রথম থেকেই বাংলাদেশীদের উপর সেই কলোনীয়াল শাসকদের মতোই আচরন শুরু করে। যে কোন বিষয়েই দুই অংশের পরিষ্কার বৈষম্য ছিলো। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও এর বাইরে ছিলো না। তাই ১৯৪৭ সালে যখন রেডিও পাকিস্তান চালু হয়, বাংলাদেশী শিল্পীদের সেখানে অংশগ্রহণ খুবই সীমিত ছিলো। বাংলাদেশী শিল্পীদের অনেকে চেষ্টা করতেন কলকাতার আকাশবাণীতে বাংলা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে, কিন্ত সেখানেও ভারতীয় বাঙ্গালীদের সাথে অসম প্রতিযোগিতা ছিলো। তাই খুব কম বাংলাদেশীই সেখানে সফল হতেন। আমাদের শিল্পীদের অনেক সময় উর্দুতেও পরিবেশন করে সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হতো, এবং যথারীতি সেখানেও তাদের ভালো সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই ছিলো। তবে বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর কিছু পরিবর্তন আসতে থাকে আমাদের দেশের মধ্যে। বেশ উদ্দীপনা শুরু হয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ঐ সময়টাতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মাতে থাকে, যেগুলি আমাদের শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতো। সেটা এক নতুন রকমের জোয়ার। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আয়োজিত এই অনুষ্ঠানগুলো থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন প্রতিভা। মায়েরা দুই বোন ছাড়াও সমসাময়িক দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন আরও অনেক পরবর্তীতে নামকরা শিল্পী, তাদের মধ্যে আছেন আবদুল আলীম, আবদূর রউফ, ফেরদৌসী রহমান, মাহমুদুননবী, নীনা হামিদ, আব্দুল জব্বার প্রমুখ। যারা ঢাকায় থাকতেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা প্রায় নিয়মিতই একসঙ্গে গাইতেন। তখন যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিলো ট্রেন। বিভিন্ন জেলা শহরে অনুষ্ঠানগুলোতে শিল্পীরা সবাই একসঙ্গে যেতেন আবার একসঙ্গে ফিরতেন। সে এক ভিন্ন আবহ। শিল্পীদের মাঝে গড়ে উঠেছিলো এক বিরাট পারস্পরিক সমঝোতা আর নির্ভরতা।
আমার মা গান গেয়ে যে পরিচিতি পাওয়া শুরু করেন সেটা কিন্তু চলচ্চিত্র, টিভি বা রেডিওর মাধ্যমে না, এই সব লাইভ ‘ফাংশন’-এর মাধ্যমেই। হ্যাঁ, তখন এই অনুষ্ঠানগুলোকে ‘ফাংশন’-ই বলা হতো। বড় খালা-তো ঢাকায়ই থাকতেন, উনি ঢাকাতেই বেশীরভাগ অনুষ্ঠান করতেন এবং চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকও গাইতেন। এদিকে বিভিন্ন ছুটিছাটায় মা-ও ঢাকাতে আসতেন। তখন ঢাকাতে উনিও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতেন। গানের সাথে কিছু পারিশ্রমিকও থাকতো। এইভাবেই দুই বোন স্বাধীনভাবে উপার্জনও শুরু করলেন। তাই মায়েরা দুই বোন বাবাকে প্রস্তাব দিলেন উনার চাকরীর যেমনই পরস্থিতি হোক, বাসা যেনো আর বদল না করতে হয়। এক বছরের মাথায় বড় খালা তার কোন এক সূত্র ধরে শান্তিবাগে একটা বাসা ভাড়া করে ফেললেন। নানা-নানী তাদের চার মেয়ে সহ সেই বাসায় গিয়ে উঠলেন। মা ঐ মুহুর্তে রাজশাহীতে। সেজোবোনের চিঠি পেয়ে উনি ঢাকা চলে আসলেন। ঢাকাতে মায়েদের দুই বোনের জনপ্রিয়তা এবং উপার্জন এতোটাই ভালো হতে থাকলো যে মা সিদ্ধান্ত নিলেন আর রাজশাহী যাবেন না এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাটা ঢাকা থেকেই দিবেন।
এই সময়টাতে মাা ঢাকা ভার্সিটির বিভিন্ন হলের প্রোগ্রামে গান গেয়ে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মূলত সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, তৎকালীন জিন্নাহ হল, এবং ঢাকা হলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মা ছিলেন একজন নিয়মিত মুখ। হলগুলির ‘এন্টারটেইনমেন্ট সেক্রেটারী’ পদে যারা ছিলো, তাদের কাজ ছিলো শিল্পী যোগাড় করা। আমার বাবা কিছুদিনের জন্য উনার হলে এই পদে ছিলেন। যদিও তখন তাদের মধ্যে পরিচয় ছিলো না, তবে বাবাও কিন্তু মা-কে নিমন্ত্রণ করে এনেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তবে সরাসরি যোগাযোগ হতোনা, যোগাযোগ হতো সঙ্গীত পরিচালনায় যিনি থাকতেন তাদের মারফত। বিভিন্ন হলে বিভিন্ন সময়ে বাবার মতো ‘এন্টারটেইনমেন্ট সেক্রেটারী’ পদে ছিলেন মাসুদ রানা খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেন, এবং ফজলুল হক। এয়া সবাই বিভিন্ন সময়ে মা-কে এসব প্রোগ্রামে ডেকেছেন। কালক্রমে এরা তিনজন ভায়রা ভাই হয়ে গিয়েছিলেন, এটাও একটা মজার ঘটনা। ফজলুল হক ১৯৬০ সালে বিয়ে করেন মায়েদের তৃতীয় বোন নাজমা ইয়াসমিনকে। কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন মায়ের বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিনকে, এবং বাবা-মায়ের বিয়ে হয় ১৯৬৩ সালে।
মায়ের মনে আছে এইসব প্রোগ্রামে যে পরিমান রোজগার হতো সেটা ছিলো তার প্রয়োজনের অনেক বেশী। দশ-বিশ টাকাই যেই সময় অনেক বেশী কিছু ছিলো, সেই সময় মায়ের ব্যাগে সবসময়ই দু’শো-তিনশো টাকা থাকতো। রোজগার হলেই বাসায় টাকা নিয়ে এসে একটা ট্রাঙ্কে তার মুখটা খুলে ঢুকিয়ে রেখে দিতেন। কালক্রমে তা উঁচু হতে থাকে। তখন আর কি করা, একটা ভারী কিছু দিয়ে চেপে রেখে দেয়া। একদিন নানা দেখে বললেন, টাকাগুলো এভাবে না রেখে ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলে ফেলতে। বুদ্ধিটা মনে ধরে মায়ের। তৎকালীন ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক (বর্তমানে সোনালী ব্যাঙ্ক)-এ গিয়ে একাউন্ট খুলতে গেলেন। সবই ঠিক আছে কিন্তু ম্যানেজার বললেন একাউন্ট তো খোলা যাবেনা, কারন একাউন্ট খুলতে সর্বনিম্ন আঠারো বছর বয়স হতে হবে। মায়ের যে তখনো আঠারোই হয়নি। ভাগ্যিস আরেকটা অপশন ছিলো। ম্যাট্রিক পাশ হলেও একাউন্ট খোলা যেতে পারে। সেই সার্টিফিকেট দেখিয়েই শেষ পর্যন্ত একাউন্টটা খোলা সম্ভব হয়েছিল। আর, টাকাগুলো দিয়ে মা কি করতেন? মূলত পড়ার খরচ চালানোর জন্য জমা রাখলেও সখের কিছু জিনিষ কেনার তো বাধা ছিলো না। সতেরো আঠারো বছরের মায়ের সরল স্বাধীন জীবনের একটা আনন্দ ছিলো নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে ইচ্ছামতো চকলেট কিনে খাওয়া।
ফাংশনে গান
১৯৫৭ থেকে ১৯৬০, এই তিন বছরে আমার মা ফওজিয়া ইয়াসমিন বিভিন্ন কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আর বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সঙ্গঠকদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে দেশে যথেষ্ট পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। ’৬০ সালে রেডিওতে অভিষেক হওয়ার পর সেই পরিচিতি আরো দ্রুত ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন জেলায় হওয়া এই অনুষ্ঠানগুলো মা এবং সমসাময়িক শিল্পীদের এনে দেয় দেশব্যাপী খ্যাতি। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুল আলীম, খন্দকার ফারুক আহমেদ, আনজুমান আরা বেগম, ফেরদৌসী রহমান, আনোয়ারউদ্দীন খান, লীনা নাজমুল, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, নীনা হামিদ, আব্দুর রউফ, মাহমুদুন্নবী, আব্দুল জব্বার, এরকম অনেকে। ষাট দশকের গোল্ডেন জেনারেশন এরা। ’৭১-এর স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে এরাই ছিলেন দেশের সঙ্গীত জগতের পরিচিত মুখ। আমার মা ’৬০ থেকে ’৬৩, এই তিন বছর তার শিল্পীজীবনের চূড়ায় ছিলেন। ১৯৬৩ সালে বিয়ের পরে আর জেলায় জেলায় ঘুরে অনুষ্ঠান করতে যাননি। বিয়ের পরে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে যেটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয় সেইরকম আর কি। তবে এই নিয়ে মায়ের কোন আক্ষেপ নেই। সবসময়ই তিনি বলতেন সংসার সবার আগে। সংসারেই যে তার সর্বোচ্চ আগ্রহ ছিলো সেটাও আগের অংশেও বলেছি। তাই মোটামুটি ’৬৩-এর পর থেকেই খুব নিয়ন্ত্রিতভাবে তিনি সঙ্গীতে সময় দেয়া শুরু করেন। খুব বেছে বেছে অনুষ্ঠান নিতেন, ঘন ঘন অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতেন। বিয়ের পরপরই মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যান। শিক্ষকতা পেশা হিসেবে নেবেন এটা বহুদিনের একটা লক্ষ্য ছিলো। সেই হিসেবে পড়ালেখাতেই সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে থাকেন সঙ্গীতের ক্যারিয়ারের একেবারে মধ্যগগনে থেকেও। তবে পেশাদারী সঙ্গীতজীবনের সেইসময়কার স্মৃতিগুলো এখনো জ্বলজ্বলে। এখনো আমরা যখন জানতে চাই, নির্ভুলভাবে সব ঘটনা স্মৃতির কোঠা থেকে বের করে আমাদের চমৎকৃত করে দেন।
ষাটের দশকের সে সময়টায় শিল্পীদের ট্রেনের যাত্রাগুলো খুব রোমাঞ্চকর ছিলো। অবশ্য ঢাকা শহরেই বেশীর ভাগ অনুষ্ঠানগুলো হতো এবং সেগুলোতে মায়েরা সাধারনত রিকশা করেই যেতেন। কিন্তু ঢাকার বাইরের অনুষ্ঠানগুলোর জন্য ট্রেনই ছিলো প্রধান মাধ্যম। মূলতঃ শীতকালে হতো এসব অনুষ্ঠান। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ এই চার বছরে মা অন্যান্য শিল্পীদের সাথে বেশ কয়েকটা শহরে অনুষ্ঠান করেছেন। জায়গাগুলো এখনো উনার মনে আছে। কালিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, ভৈরব, সিলেট, চৌমুহুনী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সরিষাবাড়ী, নওগাঁ, রাজশাহী এরকম আরো কত নাম। ঢাকার বাইরে প্রথম প্রোগ্রাম মা করেন নওগাঁতে ১৯৫৯ সালে। সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসের নেতৃত্বে ছিলো সেই সঙ্গীত দলটি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পীরা দলে থাকতেন। মা-এর সাথে বেশী ঘন ঘন একই দলে থাকতেন নীনা হামিদ, আব্দুল আলিম প্রমুখেরা।
আচ্ছা, এই শিল্পীদের পারিশ্রমিক তখন কেমন ছিলো? লাইভ ফাংশনে মোটামুটি দুইশত টাকা পারিশ্রমিক ছিলো একেকজন শিল্পীর। একটা হিসাব দেই। আমার বড় খালা ফরিদা ইয়াসমিনের কথা মনে আছে নিশ্চয়। মাঝখানে বড়ো খালার কথা বলিনি, তার একটা বড় কারন ছিলো। উনি ঢাকার ভিতরেই এতো অনুষ্ঠান পেতেন এবং প্লেব্যাক গাইতেন যে ঢাকার বাইরে যেতেন না। তাই তার রোমাঞ্চকর ট্রেনভ্রমনও কম। ঢাকায় থাকার কারনে তার রেডিওতে অভিষেক কিন্তু মায়েরও দুই বছর আগে, ১৯৫৮ সালে। রেডিওতে পারিশ্রমিক লাইভ ফাংশনের থেকে অবশ্যই কম। বিশ টাকা। কিন্তু লাইভ অনুষ্ঠান, প্লেব্যাক আর রেডিও প্রোগ্রাম মিলিয়ে তার আয় রোজগারও ততদিনে অনেক, জনপ্রিয়তাও অনেক। ‘৬২ সালে উনি মা এবং নানাকে নিয়ে একত্রে মীরপুরে একবিঘা জনি কিনে ফেললেন। উনি দিলেন দশ কাঠার দাম, মা আর নানা পাঁচ কাঠা করে। একবিঘা জমির দাম পড়লো কত? ২,৩৮০ টাকা। ২,৪০০ চেয়েছিলো, দরদাম করে বিশ টাকা কমানো গেছিলো। তাহলে কাঠা প্রতি পড়লো ১২০ টাকা। তাহলে হিসেব বলছে মাসে দুই বা তিন দিনের পরিশ্রমে মায়ের যে রোজগার, তাতে প্রতি মাসে আমার মা ঐরকম জায়গায় তিন চার কাঠা জমি কিনতে পারতেন। এখনকার হিসেবে ঢাকা শহরের একটু বাইরে যেখানে পাঁচ-ছয় লাখ থেকে দশ লাখ টাকায় কাঠা পাওয়া যায় সম্ভবত সেরকম জায়গাই ছিলো তখন মীরপুর এগারো নম্বরের জায়গাটা। অবাস্তব অবাস্তব মনে হচ্ছে টাকার হিসাবগুলো। তবে শিল্পীদের পারিশ্রমিক খারাপ ছিলো না, সেটা বলার জন্যই এতো হিসাব নিকাশের অবতারনা।
কন্ঠশিল্পী খন্দকার ফারুক আহমেদ ছিলেন একজন ভালো সংগঠক। তার বিভিন্ন পরিচিত সূত্র ধরে ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে অনেক ‘ফাংশন’ বা গানের অনুষ্ঠানগুলোতে মায়েরা গান গেয়েছেন। ঢাকার বাইরের অনুষ্ঠানগুলোতে আয়োজকরা সাধারনত আগেই এসে ট্রেনের টিকেট হাতে হাতে উনার কাছে পৌঁছে দিতেন। উনি শিল্পীদের যাত্রার দিনক্ষণ এবং ট্রেনের সময় জানিয়ে দিতেন। মহিলা শিল্পীরা সাথে কাউকে নিয়ে যেতেন নিরাপত্তার জন্য। দূরের যাত্রা হলে বেশীরভাগ সময় মায়ের সাথে সংগী হতেন আমার নানী। সেই হিসাবে আমার নানী ছিলেন আমার মায়ের ম্যানেজার। ঢাকার ভিতরে বা অল্প দূরের অনুষ্ঠানগুলোতে মায়ের সঙ্গী হয়ে যেতেন কখনও নীলা খালা (নীলুফার ইয়াসমিন), কখনও ছোট খালা (সাবিনা ইয়াসমিন)।
যাত্রার দিনে সকালে শিল্পীরা ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে এসে একত্রিত হতেন। তারপর একসঙ্গে যাত্রা করতেন। যদিও দুয়েকবার প্রথম শ্রেণীতে গেছেন, তবে বেশীরভাগ সময় শিল্পীদের জন্য বরাদ্দ থাকতো সেকেন্ড ক্লাস, যাকে এখন আমরা ইকনোমি ক্লাস বলি। ছেলে শিল্পীরা একটা বগি দখল করতেন আর মেয়েরা আরেকটা। সকালে যাত্রা শুরু করে দুপুর নাগাদ পৌঁছানো, আবার অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে থেকে পরের দিন সকালের ট্রেনে ফেরত। স্টেশনে ফেরত এসে যে যার মতো আবার রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যেতেন। শিল্পীদের তিন বেলা ভালো খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আর রাতে থাকার ব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে হতো। বেশীরভাগ সময়ে স্থানীয় হাইস্কুলে বিছানার আয়োজন করে ফেলা হতো। কখনো কখনো রেস্টহাউস, আবার কখনো বা কোন এক আয়োজকের বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা হতো। মায়ের অবশ্য এই রাতে থাকাটাই সবচেয়ে অপ্রিয় ছিলো। নিজের জায়গাটা না পেলে তার ঘুমই আসতো না।
মাঝে মাঝে দুয়েকটা ছোট ছোট ঘটনা যে ঘটতো না তা নয়। একবার এক অনুষ্ঠান শেষে শিল্পীরা রাত কাটিয়ে পরের দিন ট্রেনে ফেরার সময় দেখা গেলো একটা টিকেট কম। সেই দুর্ভাগা শিল্পী হলেন আবদুল আলীম। খুব সরল সোজা মানুষ ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আয়োজকদের কাছ থেকে টিকেট নিয়ে নেয়ার নিয়ম। কিন্তু সেদিন তিনি কি করে যেনো ভুলে গিয়েছিলেন। এদিকে ট্রেনে ওঠার সময় আর তো টিকেট কাটার সময় নাই। সবাই চলে যাবে আর একা একা পরের ট্রেনে উনি যাবেন ব্যাপারটা বড়ই কষ্টকর। আবার নিজের পয়সায়ই বা কেনো টিকেট কাটতে যাবেন? তখন উপায় না দেখে উনি টিকেট চেকারকে তার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন তাকে এই ট্রেনে যেতেই হবে না হলে যে বিকালে রেডিওতে তার যে একটা লাইভ প্রোগ্রাম আছে, সেই প্রোগ্রামটাও মিস হয়ে যাবে। অনুরোধ করতে লাগলেন তার একটা ব্যবস্থা করে দিতে। ততদিনে আবদুল আলীম কিন্তু তুমুল জনপ্রিয়। কিন্তু তাতে কি, সেটাতো রেডিওর যুগ। সাধারন মানুষ তো তার চেহারা চেনে না। তাই টিকেট চেকারও তার অপারগতা জানাতে থাকলো। কিন্তু আবদুল আলীমের অনুরোধের ঠেলায় শেষে অনেকটা বিরক্ত হয়েই সে বললো যে উনি যদি একটা গান শুনিয়ে প্রমান করতে পারেন যে তিনি আবদুল আলীম, তাহলে একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাথে সাথে আবদুল আলীম স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েই, ‘আর কতোকাল ভাসবো আমি…’ বলে একটা টান দিলেন। মুহুর্তেই টিকিট চেকার চিনে ফেললেন উনাকে, আর দৌঁড়ে সাথে করে নিয়ে গেলেন ট্রেনের ড্রাইভারের কাছে। পুরো পথটা আবদুল আলীম ড্রাইভারের পাশে বসেই সেই যাত্রাটা কাটিয়েছেন। অবশ্য ড্রাইভারকে কতগুলো গান শুনাতে হয়েছিলো সেটা জানা যায়নি।
আরেকবার মা সাথে করে নিয়ে গেছেন আমার সাবিনা খালাকে। তখন খালার মাত্র দশ বছর বয়স। আসার সময় ট্রেনের ভিতরেই হঠাৎ কেউ একজন আবিষ্কার করলো তাদেরকে সেকেন্ড ক্লাসের বদলে থার্ড ক্লাসের টিকেট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এদিকে বরাবরের অভ্যাসমতো তারা তো সেকেন্ড ক্লাসেই উঠে বসে আছেন। ফুলবাড়িয়া গিয়ে টিকিটচেকারকে বলতে হবে, তারপর কিছু জরিমানা দিয়ে তারপর ছাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু এতো হুজ্জত কে করে। তাছাড়া শিল্পী মানুষের তো মান সম্মান বলে একটা কথা আছে। তার উপর তারা তো আর টিকেট নিজেরা কাটেননি। এদিকে বয়সের একটা উত্তেজনাও আছে। কেউ একজন কুবুদ্ধি দিলো তেজগাঁ স্টেশনে এসে নেমে যাবে সবাই। মা চাননি, কারন দশ বছর বয়সী সাবিনা খালাকে নিয়ে অচেনা জায়গা থেকে বাসায় যাওয়া একটা বিরাটা ঝামেলা। কিন্তু বাকীরা সবাই রেডি হয়ে গেলো নামার জন্য। এখন দল ছেড়ে একা একা ফুলবাড়িয়া স্টেশনে টিকেটচেকার কে সামলানাও আরেক ঝামেলা। তাই বাধ্য হয়ে তিনিও নেমে গেলেন সবার সাথে। বলাই বাহুল্য সেদিন সেই ছোট্ট সাবিনা খালাকে নিয়ে তেজগাঁ থেকে রিকশা করে বাসায় যেতে অনেক কষ্টই হয়েছিলো মায়ের।
এরকমই আরেক দিন। ১৯৬২ সাল। সেবারও দশ বছর বয়সী ছোটখালা মায়ের সঙ্গী। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো একটু আগে আগেই। কিন্তু দর্শকশ্রোতা আরো গান শুনতে চান। এদিকে শিল্পীরা আর গাইতে চাচ্ছেন না। তখন মা হঠাত কি চিন্তা করে ছোটখালাকে বললেন একটা গান গেয়ে দিতে। বাসায় ছোটখালা বড় বোনদের দেখে দেখে ঐ ছোট্ট বয়সেই গান গাইতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু তখনো বাইরে গান গাননি। কিন্তু উনার তেমন কোন ভয়-ডর বা অস্বাচ্ছন্দ নেই। তিনি গাইতে রাজী। তারপর তিনি গাইলেন তখনকার বেশ পরিচিত কন্ঠশিল্পী নাহিদ নিয়াজীর একটা জনপ্রিয় গান, ‘আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার সাথে কইবো কথা’। খুব সহজ গান কিন্ত না। তার উপর জীবনের প্রথমবারের মতো স্টেজে গান গাওয়া। কিন্তু উনি একেবারে নির্ভুলভাবে গেয়ে ফেললেন। গান শেষে দর্শকরাও মুগ্ধ। নীনা হামিদ তো মা-কে বলেই ফেললেন, ‘তোমার এই ছোটবোন একদিন বড় কিছু হইবো আমি বইলা দিলাম।‘ এভাবেই হয়ে গেলো আমাদের কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের অভিষেক।
দুইবার ট্রেন লেট করেছিলো। প্রথমবার যেবার ভৈরবের অনুষ্ঠান থেকে আসার সময় ট্রেন লেট করলো সেবার ফেরার সময় শিল্পীদের যাত্রাসঙ্গী ছিলেন ওস্তাদ আয়েত আলী খান। হ্যাঁ, আমার দাদা। উনিও সেই অনুষ্ঠানে বাজিয়েছিলেন। উনি বাজাতেন সুরবাহার। অনুষ্ঠানেই মা তাঁকে দেখেছিলেন, কিন্তু পরিচয় ছিলো না তাই কথা হয়নি। দাদাও ট্রেনে ঢাকা যাবেন। উনার বড়ো ছেলে মানে আমার বড়ো চাচা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান তখন রেডিওতে সঙ্গীত পরিচালক। মতিঝিল কলোনীতে সরকারী কোয়ার্টারে থাকেন। দাদা কুমিল্লায় থাকতেন, তবে মাসে একদিন রেডিওতে প্রোগ্রাম করতেন, তখন বড় ছেলের বাসায় উঠতেন। এদিকে উনি স্টেশনে এসে পড়ায় অন্যান্য শিল্পীরা যারা তাঁকে চেনেন তারা তো বটেই, যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না তারাও ‘ওস্তাদজী, ওস্তাদজী’ বলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে লাগলেন। মা-ও সবার দেখাদেখি দাদাকে সালাম করলেন। দাদা একেবার সাদামাটা মানুষ ছিলেন। মা-কে দেখে জিগেস করলেন, ‘তোমার নাম কি মা?’ মা নাম বললেন। দাদা বললেন, ‘নামে তো চিনি। তুমি সুন্দর গান গাও। আর কিছু কি করো?’ মা বললেন, ‘আর তো কিছু করিনা, তবে আমি বিএ পড়ছি, ইডেন কলেজে।‘ খুব খুশী হলেন দাদা। এদিকে ট্রেন লেট হওয়াতে ওস্তাদজী কিভাবে বিশ্রাম নিবেন এই আলোচনা চলতে চলতে কেউ একজন, কাছেই যার বাসা, তিনি বাসা থেকে একটা মোটা চাদর নিয়ে আসলেন। ওটাকেই বিছানার মতো বানিয়ে আমার দাদা বিশ্রাম নিলেন ট্রেন আসার আগ পর্যন্ত। আমার বাবার অজান্তেই দাদার সাথে আমার মায়ের এভাবেই পরিচয় পর্ব ঘটে গেলো।
থিয়েটারে গান
এই ‘ফাংশন’-গুলো ছাড়াও মায়ের আরেকটা বিচরণক্ষেত্র ছিলো মঞ্চ-থিয়েটার। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সেই সময়টায় থিয়েটারে বিভিন্ন ছায়াছবির নাটক-সংস্করণ হতো। খুব বেশী ভেন্যু ছিলো না। দুই কি তিনটা ছিলো বেশী ব্যস্ত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ব্যস্ত ভেন্যু ছিলো ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত ‘মাহবুব আলী ইন্সটিটিউট’। আর থিয়েটার আয়োজকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী খ্যাতনামা ছিলো মিনার্ভা থিয়েটার। তখনকার একজন ব্যস্ত সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মনোতোষ দেব তিনিই একদিন মা-কে একটা ফাংশনে দেখে তাকে থিয়েটারে গান গাইবার প্রস্তাব দেন। মা রাজী হন। এরপর থেকেই শুরু হয় মায়ের থিয়েটার গান গাওয়া। মনতোষ দেব ছাড়াও মা কাজ করেছেন শেখ মোহিতুল হক, কল্লোল প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে।
থিয়েটারের ব্যাপারটা ফাংশনের চেয়ে একটু ভিন্ন। এখানে নাটকের নায়িকা অভিনয়ের মাঝেই কোন একটা সময় গান গাওয়া শুরু করবেন। যেমন ছায়াছবিতে হয়। ঠিক ঐ সময় সাইডস্টেজে সঙ্গীতশিল্পী গান গাওয়া শুরু করবেন। আর নায়িকা মঞ্চে মুখ নাড়াবেন। সাইডস্টেজে সঙ্গীত পরিচালকের সাথে সঙ্গীতশিল্পী আর যন্ত্রীরা রেডি থাকতেন। সময়মতো নাটকের ডিরেক্টেরের সিগন্যাল পেলে গান শুরু হয়ে যেতো। এভাবেই মায়ের থিয়েটারে গান গাওয়া পর্ব শুরু। মায়ের যতদূর মনে পড়ে থিয়েটারে মায়ের গান গাওয়া শুরু হয় ১৯৫৯ সালে।
মায়ের গানে ঠোঁট মিলানো নায়িকাদের মধ্যে আজমেরী জামান ছিলেন অন্যতম। উনি রেডিওর অনুষ্ঠান ঘোষিকাও ছিলেন, এবং পরবর্তীতে মায়ের বিয়েতে ঘটকের ভূমিকায়ও ছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশী ঠোঁট মিলিয়েছেন চিত্রনায়িকা সুজাতা। সুজাতার প্রথম ঠোঁট মেলানো কিন্তু মায়ের গানের সাথেই। সুজাতা তখন উঠতি নায়িকা। কুষ্টিয়া থেকে মাত্র ঢাকায় এসেছেন। হাতে দুই একটা ছবি। সাথে থাকতো এই থিয়েটার গুলো। মায়ের সবচেয়ে বেশী মনে আছে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছায়াছবিটার থিয়েটার সংস্করণটার কথা। ১৯৩৫ সালে প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিটার রি-মেক হয় ১৯৫৮ সালে। খুব জনপ্রিয় এই ছায়াছবি ঢাকার থিয়েটারেও খুব জনপ্রিয়তা পায়। অনেক শো হয়েছিলো এই নাটকটার।
মজার কথা এই থিয়েটারগুলোয় মায়ের সাথে অনেক নাটকে নায়িকা ছিলেন মায়ের পিঠাপিঠি ছোটবোন নাজমা ইয়াসমিন। যদিও গান তিনিও শিখেছিলেন, তারপরও উনিই মায়েদের একমাত্র বোন যিনি সঙ্গীতজগতে প্রবেশ করেননি। তাই অনেকটা অপরিচিতই থেকে যান তিনি। পরবর্তীতে পিএইচডি শেষ করে তিনি ঢাকাতে একটা স্কুল দিয়েছিলেন এবং সেটার প্রিন্সিপাল ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০২২ সালে উনি উত্তরায় একটি ক্লিনিকে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৯ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নাজমা ইয়াসমিন নাটকের মূল চরিত্রে অভিনয় করতেন। তার সাথে অনেক নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন ঝর্ণা বসাক, পরবর্তীতে শবনম হিসেবে যিনি ছায়াছবিতে প্রতিষ্ঠা পান।
রেডিওতে গান
ফাংশন এবং থিয়েটারের ব্যস্ততার মধ্যেই ঘটে গেলো স্মরণীয় আরেক ঘটনা। ১৯৬০ সালের ২৮ই মার্চ মা প্রথমবারের মতো রেডিওতে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। যদিও ততদিনে দেশের পরিচিত মুখ, কিন্তু যেহেতু প্রথম অনুষ্ঠান, তাই তাকে দেয়া হলো নতুন শিল্পীদের সাথে। প্রটোকল বলে কথা। সেটাও একটা মজার স্মৃতি। কাকতালীয়ভাবে একই দিনে এমন কি একই অনুষ্ঠানে আম্মার সাথে রেডিওতে অভিষেক ঘটে গেলো ‘ওরে নীল দরিয়া’ খ্যাত শিল্পী আবদুল জব্বারের। উনি তখন কুষ্টিয়াতে থাকতেন। সেখানে যথেষ্ট পরিচিতি থাকলেও ঢাকায় না থাকার কারনে দেশব্যাপী তখনও পরিচিত হননি। ঐ দিন থেকেই শুরু হয়ে গেলো মায়ের রেডিও শিল্পী হিসেবে পরিচিতি। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সেই এগারো বছরে মা-র জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ছিলো। এরই মধ্যে টিভি স্টেশন চালু হয়ে যায়, এবং টিভিতেও মা অংশ নিতে থাকেন। রেডিও ও টিভিতে মা মোটামুটি সত্তর এবং আশি দশকের পুরোটাতেই ব্যস্ত ছিলেন।
গ্রামোফোন রেকর্ড
গ্রামোফোনে রেকর্ড কোম্পানী ‘His Master’s Voice’ বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তার যাত্রা শুরু করে ১৯৬২ সালে। তখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের গান রেকর্ড করা শুরু করে। অনেকেই অনেক রকমের গানের অফার পাচ্ছিলেন। বাংলা ছড়াগানের চাহিদা থাকলেও তখন পর্যন্ত কেউ গ্রামোফোনে রেকর্ড করেননি। মা-ই প্রথম এই অফারটা পান। তিনিও রাজী হয়ে যান। কাজী লতিফা হকের লেখা এবং খান আতাউর রহমানের সুর করা দু’টো গান দিয়ে বাংলাদেশে মায়ের গলাতেই গ্রামোফোন রেকর্ডে ছড়া গানের যাত্রা শুরু হয়। মা বেশ ভালো জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাকে ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের আলপনা (আলপনা ব্যানার্জী)-ও বলা হতো। গান দু’টো ছিলোঃ ‘আজ পুতুলের গায়ে হলুদ, কাল পুতুলের বিয়ে’, এবং ‘গুনগুনিয়ে গান ধরেছে টুনটুনি লো’। গ্রামোফোন কোম্পানী শিল্পীদেরকে রয়ালটি বাবদ সম্মানী দিতো। মায়ের মনে আছে প্রথমবার সতেরো টাকা পঞ্চাশ পয়সা পেয়েছিলেন। সেই সময়কার সাপেক্ষে খুব খারাপ ছিলো না টাকার অংকটা।
ছায়াছবিতে গান
ষাটের দশকের প্রাক্কালে আর ঠিক শুরুর ঐ সময়টায় ছায়াছবিতে প্লেব্যাক বেশী করতেন মায়ের বড়োবোন ফরিদা ইয়াসমিন এবং ফেরদৌসী রহমান। মা খুব বেশী প্লেব্যাক করেননি। এরপর ১৯৬৩ বিয়ের পর সংসারকেই প্রাধান্য দেয়ায় এবং বাবার-ও এ ব্যাপারে উতসাহ না থাকায় মায়ের তেমন প্লেব্যাক করা হয়নি। তবুও মা প্রথমবারের মতো প্লেব্যাক করেন বাবার উতসাহেই। ‘ইয়ে ভি এক কাহানী’ ছবিতে ’৬৩ সালের শেষ দিকে। গানটি ছিলো বড় খালা ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে মায়ের একটা ডুয়েট। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন করিম শাহাবুদ্দিন। এর পর এক বড়ো বিরতি দিয়ে ১৯৬৭ সালে আরেকবার প্লে-ব্যাক করেন ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ ছায়াছবিতে। এটি ছিলো তার একক গান। মায়ের মনে আছে এক বছর বয়সের আমার বড়ো বোনকে নিয়ে তিনি এই গানটি করেছিলেন। এরপর আরো কিছু প্লেব্যাক করেন মা, তবে তার মূল কমিটমেন্ট ছিলো সংসারের প্রতি। তাই তিনি নিজেকে পরবর্তীতে রেডিও এবং টিভিতেই সীমাবদ্ধ রাখেন।
টিভিতে গান
বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। তবে শিল্পীরা ডাক পাওয়া শুরু করেন ১৯৬৫ সাল থেকে। মা-ও প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে গান গান সেই বছরেই। প্রথম দু’টো গানের সুরকার ছিলেন জালাল আহমেদ।
এলবাম
মা-এর যুগে রেডিও টিভি এবং চলচ্চিত্রই ছিল গানের মূল মাধ্যম। রেডিওতে রেকর্ড হতো ডিস্কে। সেগুলো সবই সংরক্ষিত হতো রেডিও বাংলাদেশের আর্কাইভে। এইজন্য মা-এর যুগের শিল্পীদের এলবাম খুব একটা নেই। অবশেষে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমার বোনের উদ্যোগে মায়ের প্রথম এলবাম রিলিজ হয় 'লেজার ভীষণ' থেকে। ২০১১ সালে। এলবামের নাম 'মন তো নয় আর আয়না'। মায়ের সচেয়ে পরিচিত গানের প্রথম লাইনগুলোর সাথে মিলিয়ে। এই এলবামে ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত মায়ের গাওয়া সমস্ত শ্রোতাপ্রিয় গানগুলি স্থান পেয়েছে।
গানের প্রথাগত শিক্ষা
স্রষ্টাপ্রদত্ত সুন্দর গানের গলাতো আছেই। এছাড়াও মা গানের তালিম নিয়েছিলেন দুইজন ওস্তাদের কাছে। প্রথমজন ওস্তাদ ইউসুফ খান কোরেশী। ১৯৬০ সালের দিকে উনি রেডিওতে একটা গানের ক্লাস চালাতেন। সেখানে মা এবং আমার বড় খালা ফরিদা ইয়াসমিন দুজনেই যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়াও একই ক্লাসে যোগ দিয়েছিলেন 'মাসুদ রানা' খ্যাত লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনও। সেখানেই বড় খালা ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে উনার পরিচয়, পরবর্তীতে প্রণয়, এবং শেষে পরিণয়। এছাড়া এরপর মা গান শিখেছিলেন সেসময়ের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ কণ্ঠশিল্পী ওস্তাদ ফজলুল হকের কাছে। উনি বাসায় এসে শিখাতেন। মা এবং বড়ো খালা ফরিদা ইয়াসমিন, দুজনে একসঙ্গে শিখতেন। পরবর্তীতে বড় খালার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর মা একই কিছুদিন শিখেছেন। ওস্তাদ ফজলুল হক গান শিখতে একটা পয়সাও নিতেন না, একটু আত্মভোলা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। গান শিখতে এসে শেখানোর কাজটুকুর পরে নিজেই ঘন্টার পর ঘন্টা মনের আনন্দে গান গাইতেন। মায়ের বিয়ে পর্যন্ত উনি শিখেছিলেন। বাবা রেডিওতে প্রোগ্রাম প্রডিউসার ছিলেন সেই সময়টা। পরবর্তীতে বাবার প্রচেষ্টায় ওস্তাদ ফজলুল হক রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন।
সম্মাননা
যদিও মায়ের পদচারণা ছিলো বাংলাদেশের গানের সবগুলি মাধ্যমেই, এবং সেটাও নব্বই দশক পর্যন্ত, তারপরও মা সবসময়ই বলেন ‘৬০ থেকে ‘৬৩ পর্যন্ত এই তিন বছরই ছিলো উনার খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান । এরপর মা স্বেচ্ছায়ই ব্যস্ততা অনেক কমিয়ে দেন, কারন খ্যাতি বা অর্থের মোহ তাঁর কখনোই ছিলো না। একই কারনে তিনি সম্মাননা বা পুরস্কারের পিছনেও ছোটেননি। তারপরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন। তার মধ্যে আছে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রদত্ত ‘বার্ষিক গুণীজন সংবর্ধনা’। ১৯৮৭ সালে উনি গ্রহণ করেন ‘অলক্ত সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার’। মাসুদ করিম ফাউন্ডেশন ২০১৬ সালের মার্চ মাসে কিংবদন্তি শিল্পী হিসেবে মা'কে 'মাসুদ করিম পুরস্কার' প্রদান করেন। 'গোল্লাছুট পরিবার' বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মা'কে গোল্লাছুট 'শেখ রাসেল' সম্মাননা প্রদান করেন ২০২২ সালে। ২০২৩ সালের মে মাসে বিষয় মা দিবস উপলক্ষে উত্তরা পাবলিক লাইব্রেরি আয়োজিত অনুষ্ঠানে মা'কে রত্নগর্ভা সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এছাড়াও মেঘদূত সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন মা'কে শ্রদ্ধার্ঘ জানিয়েছে মা'এর সংগীত জীবনের ৬৩ বছর পূর্তিতে, ২০২৩ সালের জুন মাসে। এই তো সেদিন ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে ইডেন কলেজের সার্ধশতবর্ষে (১৫০ বছরপূর্তি) মা-কে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হলো।
প্রত্যাবর্তন
১৯৯৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গানকে বিদায় জানিয়ে দিলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে মা সংগীতে প্রত্যাবর্তন করেন ২০০৯ সালে। মেয়ে রীনাত ফওজিয়ার একমাত্র ছেলে তাহসিন খান (তুরিন)-এর সাথে দ্বৈত কণ্ঠে আবদুল আলীমের বিখ্যাত গান 'পরের জাগা পরের জমিন'। এরপর তাহসিনের সাথে দ্বৈতকণ্ঠে আরেকটি গান করেন। এটা ছিল মৈলিক গান। মেয়ে রীনাত ফওজিয়ার লেখা এবং সুরারোপিত গানটির নাম 'বসন্তেরই গানে গানে'। নিজ দৌহিত্রের সাথে দ্বৈতকণ্ঠে গান গাওয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই একটি অভিনব ব্যাপার, এবং এরকম ঘটনা খুব বেশি আছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। গানকে বিদায় দিলেও গানের সাথে মা জড়িত ছিলেন আরো কিছুদিন। বাবা সুস্থ থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালে দুজনের পরিচালনায় শুরু করেছেন এনটিভি আয়োজিত তখনকার জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান 'বাজো এবং বাজাও'। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই দেশে প্রথমবারের মতো উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসংগীত এবং উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসঙ্গীতের মিলন ঘটে। ঠিক যেমনটি মা-বাবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতে মায়ের গানের পরিবারের সাথে বাবার যন্ত্রসঙ্গীতের পরিবারের মিলন হয়েছিল, সেটারই যেন একটা প্রতিফলন।
তৃতীয় পর্ব: ইডেন কলেজ এবং গ্রাজুয়েশন
বলেছিলাম মায়ের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহের কথা। সঙ্গীতজগতে এই এতো সব উত্তেজনার মাঝেও মা কিন্তু স্নাতকে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আম্মার খুব ইচ্ছা ছিলো হোম-ইকনমিক্স কলেজে স্নাতকে ভর্তি হবার। ১৯৬১ সালেই এর প্রথম ব্যাচের যাত্রা শুরু। মা-ও উতসাহ নিয়ে গেলেন। তখন এর অধ্যক্ষ ছিলেন হামিদা খানম। সুরকার আবদুল আহাদের বোন। মা তার সাথে দেখা করতে গেলেন। উনার রুমে ঢোকার পারমিশন পাবার জন্য একটা স্লিপে নাম লিখে পাঠাতে হয় পিওনের মাধ্যমে। নাম পাঠিয়ে মা বসে আছেন। একটু পরে মা-কে অবাক করে অধ্যক্ষা নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি মা-কে চিনে ফেলেছেন। মা বিভিন্ন কলেজে অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন, পরিচিত মুখ। এদিকে মা-ও অপ্রস্তুত। অধ্যক্ষা নিজে থেকেই বললেন তিনি কত যে খুশী হয়েছেন মা-কে এখানে ভর্তি হবার ইচ্ছা দেখে। কিন্তু দুর্ভাগ্য মায়ের যে ততদিনে প্রথম ব্যাচের পঁচিশ জনের কোটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। তবু তিনি বললেন যে যদি কেউ চলে যায় বা যদি আসন সংখ্যা বাড়ে তাহলে তিনি জানাবেন। মা আর দেরী করেননি। যদি অন্যান্য জায়গায়েও সময় পার হয়ে যায়। পাশেই ছিলো ইডেন কলেজ। সেখানে তখনও ভর্তি চলছিলো। সেখানেই ভর্তি হয়ে গেলেন। মায়ের হোমইকনোমিক্স পড়া না হলেও আমার বড়বোন কিন্তু সেখানেই পড়েছিলেন। হোমইকনোমিক্সে এসএসসি-তে ঢাকা বোর্ডে প্রথম হওয়া আমার বোন হোমইকনোমিক্স কলেজেই উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। সেখানে থেকেই উচ্চমাধ্যমিকেও ঢাকা বোর্ডে প্রথম, তারপর অনার্স আর মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে বিসিএস দিয়ে ঐ কলেজেই শিক্ষকতা শুরু করে এখন প্রফেসর । ইডেন কলেজে শুরু হলো মায়ের স্নাতক শিক্ষা। একই সাথে চললো গান। এদিকে তখন রেডিওতেও গান করা শুরু করেছেন। তবে সব মিলিয়ে মাসে তিন কি চার দিন গানের জন্য ব্যস্ততা। সেগুলোও সাধারনত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পড়ে। তাই পড়ালেখায় তেমন অসুবিধা হচ্ছিলো না। কোন একবার এক রবিবারে রাহ্মনবাড়িয়ায় একটা অনুষ্ঠানে গেছেন। অনুষ্ঠান শেষ করে পরের দিন বরাবরের মতোই ট্রেন স্টেশনে গেছেন সব শিল্পীরা মিলে। কিন্তু হঠাত জানা গেলো ট্রেন লেট। এবং নতুন সময় অনুযায়ী ভোরের আগে ট্রেন আর আসবেই না। এমন একটা সময় যে হঠাত করে নিজেদের পয়সায় হোটেল খোঁজা বা এইসব ব্যপারগুলো না করে সবাই মিলে ঠিক করলেন যে স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই গল্প করে দিনের বাকী অংশ এবং রাতটা পার করে দিবেন। আমার মা খুব একটা আড্ডার লোক না। কিন্তু উপায় নাই। তাই মেনে নিলেন। ছেলে শিল্পীদের অনেকেই খুব আড্ডাবাজ ছিলেন। মেয়েদের মধ্যেও অনেকেই যেমন নীনা হামিদও কম না। সময় ঠিকই কেটে গেলো। ভোরের ট্রেনে ফিরে সবাই বাসায় ফেরত গেলেন। সোমবারে মায়ের ক্লাস ছিলো একদম সকাল সকাল। বাসায় ফিরেই শুধু একটু স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে কলেজে চলে গেলেন। কিন্তু ক্লাস শুরু হবার পর প্রচন্ড ক্লান্তি এসে ভর করলো। একটা সময় মনে হলো যে অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তাড়াতাড়ি কোনমতে ক্লাস থেকে বের হয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে ছুটির আবেদন করলেন। ইডেন কলেজে তখন অনেক কড়াকড়ি ছিলো। মেয়েদেরকে একলা দিনের মাঝে গেটের বাইরে যেতে দেয়া হতো না। একবার সকালে গেট খুলতো, আবার একবারে সব ক্লাস শেষ হলে। কিন্তু মা আর পারছিলেন না। তখন সেক্রেটারীকে অনুরোধ করলেন প্রিন্সিপালের কাছে জানাতে। প্রিন্সিপাল তো মা-কে চেনেন শিল্পী হিসাবে। তখন স্নেহ করে বললেন, ‘ফওজিয়া, তোমার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয় পেশাদারী সঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য। এই ধরনের বিশেষ প্রয়োজন যাদের আছে, তাদের জন্য তো আমাদের স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা আছে। তোমাকেও করে দিচ্ছি। এরপর প্রয়োজন হলে যে কোন সময় এই পাস দেখিয়ে বের হতে বা ঢুকতে পারবে।’ মা-ও বিশাল খুশী হয়ে গেলেন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পেয়ে। তারপর গেট থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে ঢুলতে ঢুলতে কোনমতে বাসায় এসে সাথে সাথে ঘুম। এরকম রাতে না ঘুমিয়ে ক্লাস করার মতো ভুল আর করেননি।
চতুর্থ পর্ব: প্রণয় ও পরিণয়
এদিকে ইডেন কলেজে পড়ার সময়ই রেডিওতেও ব্যস্ততা বেড়ে গেলো। এখনকার মতো তো আর ফোন আর ইন্টারনেটের যুগ ছিলো না, একটা গান গাওয়ার পেছনে অনেকগুলো ধাপ থাকতো। যেমন, প্রথমে একটা চিঠি আসতো কবে অনুষ্ঠান সেটা জানিয়ে দেয়ার জন্য। সেটাতে গীতিকার আর সুরকারের নাম থাকতো। বেশীরভাগ সময়ে গীতিকার শিল্পীর বাসায় এসে গানটা পৌঁছে দিতেন। উনি আবার সুরকারের বাসাতেও গান পৌঁছে দিতেন। অনুষ্ঠানের পাঁচদিন আগে রেডিও অফিসে এসে শিল্পীকে গানটা জমা দিতে হতো। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে না হলেও নজরুল বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠানের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যাতে করে একই অনুষ্ঠানে একাধিক শিল্পী একই গান না বাছাই করে ফেলেন। এদিকে গান জমা দেয়ার পর অনুমোদন পেলে তখন তখনই জানা যেতো। এরপর শিল্পীকে সুরকারের তার দেয়া সময়ে তার সাথে বসতে হতো গানটা শেখার জন্য। অনেক ক্ষেত্রে সুরকারেরা রেডিওতেই চাকরীরত ছিলেন, রেডিও অফিসেই কোন এক স্টুডিওতে গান শেখানোর কাজ চলতো। পরবর্তীতে এই স্টুডিওগুলোতে ছোটবেলায় আমি অনেক গিয়েছি মা-বাবার সাথে। ছোট ছোট গোলাকৃতি ছিদ্রঅলা জিপসাম বোর্ডে মুড়ানো স্টুডিওর দেয়ালগুলো কক্ষগুলোকে শব্দনিরোধক রাখতো। ভিতর থেকে সজোরে চিৎকার করলেও দরজার বাইরে একটা আওয়াজও যেতো না। আমরা সুযোগ পেলেই একলা গিয়ে দরজা বন্ধ করে সজোরে চিৎকার প্র্যাকটিস করতাম।
তবে মায়ের যেহেতু ইডেন কলেজে ক্লাস ছিলো, তাই অনেক সময় সুরকারদের বেঁধে দেয়া সময়ে যেতে পারতেননা। তখন সুরকারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করে তাদের বাসাতেই শিল্পীদের চলে যেতে হতো। এরকমভাবেই আমার বড়ো চাচা ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের বাসাতেও আমার মায়ের বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে হয়েছিলো। বড়ো চাচা ততদিনে সুরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ঐ সময় বাবা বড়ো ভাইয়ের বাসায়ও মাঝে মাঝেই যেতেন। তবে মায়ের সাথে বাবার সেখানে কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু বড়ো চাচা মনে মনে ছোটভাইয়ের জন্য এই মেয়েটির কথা চিন্তা করা শুরু করেছিলেন।
এদিকে বাবাও রেডিওতে চাকরী শুরু করেন ১৯৬২ সালে। প্রোগ্রাম প্রোডিউসার হিসাবে। শিল্পীরা যখন গান জমা দিতে আসতেন, সেটা রিসিভ করাও ছিলো তাদের অন্যতম কাজ। বাবা এর মধ্যেই মা-কে হয়তো কয়েকবার দেখে ফেলেছেন, যদিও মা-এর বক্তব্য অনুযায়ী মা ঐভাবে বাবাকে লক্ষ্য করেননি। বাবারা দুই জন একরুমে বসতেন। বাবার সাথে ছিলেন আরেকজন প্রোগ্রাম প্রোডিউসার জামান আলী খান। একদিন রুমে গান জমা দিয়ে মা বেরিয়ে এসেছেন, তাকে পেছন থেকে জামান আলী খান ডাক দিলেন। কুশলাদি বিনিময় করে বললেন যে তার রুমে তার সাথে আরেকজন যে আছেন তার পক্ষ থেকে তিনি এটাই বলতে এসেছেন যে ভিতরের ঐ ভদ্রলোক আমার মা-কে বিয়ের প্রস্তাব দিতে চান। কিন্তু মায়ের মতামত জানা তো অবশ্যই জরুরী। তাই যাতে মা-কে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে না হয় এই জন্য তিনি মাকে অনুরোধ করছেন তক্ষুনি কিছু না বলে তিনদিন পরে হ্যাঁ বা না সেটা জানাতে। এটাও বললেন যে যদি তিনদিন পরে যদি মা না আসেন তাহলে ধরে নেয়া হবে মা রাজী নন, কিন্তু যদি মা আসেন তাহলে ধরে নেয়া হবে যে মা রাজী হয়েছেন।
মায়ের কথা অনুযায়ী পরের তিনদিনের মধ্যে মাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো। তার মা-কে অর্থাৎ আমার নানীকে জানাননি, হয়তো ওভাবে মা-কে বলাও যায়না ব্যাপারগুলো। আলাপ করার একমাত্র লোক ছিলো বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন। তবে ততদিনে কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গেছে মাসুদ রানা খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেনের সাথে। আবার মায়ের ছোটবোন আমার সেজোখালাও কিন্তু একেবারে সবার আগে বিয়ে করে এর মধ্যেই সন্তানের মা হয়ে গেছেন। সেটা আরেক গল্প। বড়খালার সাথেই আলাপ করতে চললেন মা। সুত্র কতগুলো ছিলো। বাবার পরিচয়তো তারা জানেন। রেডিওতে চাকরীরত। এন্ট্রি লেভেলে, কিন্তু তাতে কি, সরকারী স্থায়ী চাকরী। সেটা ছাড়াও তিনি ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর ছেলে, সেটাও জানা ছিলো। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর সাথেও মায়ের পরিচয় হয়ে গেছে সেই যে, ট্রেন স্টেশনে। ওস্তাদজী হিসেবে আমার দাদা সম্মানিত একজন ব্যক্তি। আবার গান শিখতে যাওয়ার সূত্র ধরে বাবার বড়ো ভাই ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে, তার বাড়িতেও যাতায়াত আছে। আমি জানি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিলেন মা। তাই তিনদিনের দিন রেডিওতে চলে গেলেন বাবার সাথে দেখা করতে। আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হলেন দু’জনে। মা বললেন যে যেহেতু মাত্র পরিচয় হলো, কিছুদিন নিজেরা কথা বললে ভালো হয়। বাবাও রাজী। সাথে এটাও বললেন যে মা যদি রাজী না হন, তাহলেও তিনি বাধা দেবেন না, তবে তিনি জীবনে আর কখনও অন্য কোন মেয়েকে বিয়ের চিন্তাও করবেন না। খুবই রোমান্টিক শোনাচ্ছে বোধহয়, তবে ততক্ষণে মা-বাবা দুইজনেই বোধহয় তাদের ‘গাট ফিলিংস’ দিয়ে বুঝে ফেলেছেন যে তাদের এই পরিচয় মিলনাত্মক পরিণতির দিকেই এগোচ্ছে।
এরপর মাসখানেক বিভিন্ন স্থানে দুজনের দেখাসাক্ষাত চললো। বেশীরভাগ সময়ে রেডিও অফিসেই,আবার কোন কোন সময় আমার বড় চাচার বাসায়, গান শেখার অজুহাতে। কাকতালীয়ভাবে প্রথম দেখার মাসখানেক পরেই একদিন আমার দাদা বাবাকে ডেকে বললেন যে উনি একটা মেয়েকে দেখেছেন, এবং বাবার জন্য উনি তাকে পছন্দ করেছেন। হ্যাঁ, সেই ট্রেন স্টেশনে পরিচয়ের সূত্র ধরেই এই পছন্দের ব্যাপারটা। বাবা নিশ্চয় ধরে নিলেন কসমিক একটা যোগাযোগ হয়ে গেছে নাহলে এরকম দুইয়ে দুইয়ে চার কিভাবে হবে। তাই উনি মা-কে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়ার কথা বললেন।
পঞ্চম পর্ব: শিক্ষকতা
সংগীত মা'কে অসাধারণ খ্যাতি দিয়েছে, যথেষ্ট আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, কিন্তু মা কখনই সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে চাননি। পেশাদারী সংগীত জীবনের যে আলগা চাকচিক্য সেটা কখনই মা'কে টানেনি। উনি সবসময় চাইতেন একটা সাধারণ জীবন, যেখানে সংসার পালন করে জীবনটা সুন্দর করে পাতিয়ে দিতে পারবেন। উনার ছেলে হিসেবে আমি বলতে পারি এই কাজটি তিনি অত্যন্ত যত্নের সাথে এবং সফলতা সাথেই করে গেছেন এবং যাচ্ছেন।
যখন তিনি তাঁর খ্যাতির তুঙ্গে, সেই ১৯৬০-৬৩ সালের সময়ও মা লেখাপড়ার কাজটা ভালোভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৬২ সালে বিএ পাশ করার পরবর্তী বছরে ১৯৬৩ সালে মা এবং বাবার বিয়ে হয়। ওই বছরই মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় মাস্টার্সে ভর্তি হন। ওই সময় মা-বাবা ঢাকার মতিঝিল কলোনিতে থাকতেন। পীরজঙ্গি মাজারে কাছে আইডিয়াল স্কুলের ঠিক পিছনে সরকারি কোয়ার্টারে বাসা। নম্বর হচ্ছে ৫৮/২। একতলায়। ওই সময় আইডিয়াল স্কুল ক্লাস এইট পর্যন্ত ছিল। প্রধান শিক্ষক ছিলেন গণি স্যার। মা ওই সময় শিল্পী হিসেবে সবার কাছে পরিচিত মুখ। বাসায় আসা যাওয়ার পথে কলোনির সবাই উনার সাথে কুশল বিনিময় করে, সবাই উনাকে চেনেন। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করা মেয়েদের জন্য যথেষ্ট সম্মানজনক ছিল। তার উপর খ্যাতিমান শিল্পী। একদিন গনি স্যার আরেকজন শিক্ষককে নিয়ে বাসায় মা'এর সাথে দেখা করতে এলেন। বললেন উনাদের স্কুল ম্যাট্রিক পর্যন্ত চালু করা হবে। তখন একজন মাস্টার্স পাশ করা শিক্ষক প্রয়োজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। মা যদি রাজি হন, তাহলে তাঁকে হেড মিস্ট্রেস করে নেয়া হবে। কেন মা'কেই তাদের প্রয়োজন জিগেস করে বললেন প্রথমত মায়ের মাস্টার্স ডিগ্রি হচ্ছে একটা কোয়ালিফিকেশন, তার উপর উনার মতো খ্যাতিমান লোক হেড মিস্ট্রেস হিসেবে থাকলে স্কুলের পরিচিতিও হবে, এবং অনেক ছাত্রছাত্রীও আসবে। অফারটা আসলে খুবই লোভনীয় ছিলো, কিন্তু মা দ্বিধা করলেন। মাত্র নতুন সংসার। অনেক কিছু তখনও গুছিয়ে নেয়া বাকি। তাই অফারটা ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা বোধ করি মনের মধ্যে গেঁথে গেলো।
এরপর ১৯৬৫ সালের ঘটনা। শান্তিনগরে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনারের অফিস ছিল, তারা একটি স্কুলপ্রতিষ্ঠা করলো সেই সময়। নাম 'ইকবাল নজরুল একাডেমী'। প্রাইমারি স্কুল। এখানে শিক্ষক হিসেবে মা'কে আমন্ত্রণ জানানো হলো। শুধু মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সেই জন্য নয়, শিল্পী এবং গায়িকা হিসেবে মা একজন পরিচিত মুখ, সেটাও একটা। মা সেখানে যোগ দিলেন। শান্তিনগর থেকে মতিঝিল কলোনি রিকশাতেই যাতায়াত করতেন। কয়েকমাস এরকম চললো। এরকম একদিন বাসায় ফেরার সময় কিছুতেই রিকশা পাচ্ছেন না। মা হাঁটা শুরু করলেন। তখন উনি আমার বড় বোনকে নিয়ে কয়েক মাসের প্রেগন্যান্ট। এভাবে হাঁটতে খুব অস্থির লাগছিলো তাঁর। কিছুদিন আগেই প্রথম সন্তান মাত্র জন্মের পরপরই মারা গেছেন। এইবার তাই অত্যন্ত সতর্ক। অনেক কষ্টে বাসায় ফিরলেন, এবং তারপরই সিদ্ধান্ত শরীরে এই অবস্থায় আর চাকরি করবেন না। সন্তানের চিন্তাটা সবার আগে। তাই মা চাকরীটি ছেড়ে দিলেন।
এরপর ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে। ততদিনে আমার বড় বোন রিমি (রীনাত ফওজিয়া) এবং আমি রূপক (তারিফ হায়াত খান) পৃথিবীতে এসে গেছি। আরেকবার মা স্কুলে চাকরি করার অফার পেলেন। এবার শান্তিনগরের ডন'স স্কুল। এখানে আমার বোনও তখন পড়তেন। তবে আমি. ছিলাম একেবারে ছোট। বাবা সেই সময় বদলির চাকরী হিসেবে রংপুরে। দুইটা ছোট বাচ্চা নিয়ে চাকরী করতে মা হিমশিম খেতে লাগলেন। তাই এবার বেশিদিন করা হলো না।
সেই বছরই নভেম্বর মাসের কথা। বাবা রংপুরে চাকরী করেন, এবং দুই সপ্তাহে একবার চাকায় এসে সপ্তাহান্তটা কাটিয়ে যান। এরকমই এক ছুটির দিনে বাবা ঢাকাতে। সকালে বাজারে দেখা হয়ে গেলো আলী আহমেদ চৌধুরীর সাথে। উনি মতিঝিল টিএন্ডটি কলেজের প্রিন্সিপাল। বাবা এবং মা দু'জনের সাথেই পরিচয় আছে। উনি বাবাকে বললেন কলেজে বাংলা বিভাগে একজন অধ্যাপক নিয়োগ করা হবে। মা'-এর তো বাংলাতেই মাস্টার্স করা আছে। মা চাইলে ওই পদে চাকরীর আবেদন করতে পারেন। মা রাজি হলেন। নিয়োগও পেয়ে গেলেন। শুরু হলো মায়ের কলেজে অধ্যাপনার চাকরি।
দুই বাচ্চা নিয়ে তখনও মা হিমশিম খাচ্ছেন। তবে আমরা দুইজন তখন একটু বড় হয়ে গেছি। আশেপাশে আমাদের কিছু আত্মীয়-স্বজন এবং প্রতিবেশী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। বাচ্চাদের মাঝে মাঝে উনাদের কাছে রেখে কলেজে যেতে পারতেন।
এভাবে কেটে যাচ্ছিলো সময়। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ঐতিহাসিক ২৬-এ মার্চ থেকে দেশজুড়ে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। প্রথম দিকে যুদ্ধের মধ্যে কিছুদিন কলেজে গেলেও এপ্রিল মাস থেকে আর যাওয়া সম্ভব হলো না। তাই এখানেই মা'এর শিক্ষকতার আপাতত বিরতি।
এরপর পুরো এক দশক পরের ঘটনা। এর মধ্যেই তৃতীয় সন্তান রাজিত (তানিম হায়াত খান) এসে পড়েছে। তিন সন্তানই তখন মোটামুটি বড়। তাই হয়তো মা আবার সিদ্ধান্ত নিলেন শিক্ষকতা জীবনে ফিরে যাবার। টিএন্ডটি কলেজ ছিলো নাইট কলেজ। ইটা মা'এর জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট। কারণ মা কখনো চাইতেন না সংসারকে কম্প্রোমাইজ করে চাকরী করতে। নাইট শিফট হলে সুবিধা এই যে সারা দিন সংসারের কাজগুলি আগের মতোই করতে পারবেন, আবার সন্ধ্যার সময় ক্লাসও নিতে পারবেন। সংসারটাও একইরকম ভাবে চালু থাকেলো আবার চাকরিও করা হলো, এবং কিছু বাড়তি আয়ও হলো। সব মিলিয়ে খুব ভালো সল্যুশন।১৯৮১ সালে মা আবার টিএন্ডটি কলেজে যোগ দিলেন।
এইবার মা সত্যি সুন্দরভাবে অনেকদিন একটানা চাকরি করলেন। ১৯৯৯ সালে স্বেচ্ছা অবসর নেয়ার আগে পর্যন্ত টানা আঠারো বছর মা টিএন্ডটি কলেজে অধ্যাপনা করে গেছেন। এই সময়টাতেই আমরা তিন ভাই-বোন বড় হয়েছি, স্কুল শেষ করে ভার্সিটি শেষ করে চাকরি জীবনে ঢুকেছি, কোনোদিন সংসারে মা'কে মিস করিনি, কোনোদিন বুঝতেও পারিনি মা কিভাবে সুন্দরভাবে সংসার এবং চাকরী দুটোই স্বচ্ছন্দে চালিয়ে গেছেন।
মতিঝিল কলোনীতে থাকে সময় যখন আমরা স্কুলে পড়তাম, সন্ধ্যার সময় আমরা দরজা বন্ধ করে পড়তে বসতাম, আম্মা হয়তো কোন এক সময় কলেজে গিয়েছেন, ক্লাস নিয়ে চলেও এসেছেন, রাতে খাবার সময় আমাদের জন্য টেবিলে খাবারও দিয়ে রেখেছেন বা দিচ্ছেন। সব কিছু যেন সুন্দর শৃঙ্খলার সাথে চলতো। কোনো কোনো সময় মা'এর বেশ রাতে ক্লাস থাকতো। তখন অনেক সময় আমি মা'যে সাথে হেঁটে হেঁটে ম'কে কলেজ পৌঁছে দিয়েছি, আবার সময়মতো কলেজে গিয়ে মা'কে সাথে নিয়ে এসেছি। নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হতো। বাসা থেকে বেরিয়ে কলোনীর ভিতর দিয়েই কিছুটা পথ মিনিট পাঁচেক হেঁটে গিয়ে কলোনীর গেট। তারপর রাস্তা। রাস্তাটা পার হলেই মুখোমুখী কলেজের গেট। গেটে ঢুকে মিনিটখানেক হেঁটেই কলেজের বারান্দা। এই হলো মা'এর নিত্যদিনের কলেজ আসা যাওয়া।
প্রথমদিকে মা'এর অনেক মজার অভিজ্ঞতা হতো। নাইট কলেজ হওয়ার সুবিধার্থে অনেক চাকুরীজীবি কলেজে ভর্তি হতেন। এদের মধ্যে অনেক সময় অনেক পরিচিতি লোকজনও ভর্তি হতেন। হয়তো বাবারই এক বন্ধু ভর্তি হয়েছেন, এখন হয়ে গেলেন মা'এর ছাত্র। আবার কলোনিতে নিত্য দেখা হয় যাদের সাথে, একেবারে ইনফরমাল সম্পর্ক, তাদের অনেকেই আবার হয়ে যান ফর্মাল ছাত্র। এরকম বহু ঘটনা আছে এই আঠারো বছরের চাকরি জীবনে।
আমরা ১৯৯৩ পর্যন্ত মতিঝিল কলোনিতে ছিলাম। সেই সময় এরকমহেঁটে হেঁটেই মা'এর কলেজ যাতায়াত। এরপর আমরা চলে যাই ইস্কাটন কলোনীতে। অনেক সময় গাড়িতে, বা অনেক সময় রিকশায় মা'কে চলাফেরা করা শুরু করতে হয়। মা অনেক সময়ই অনুযোগ করতেন। বলতেন, যে কারণে চাকরিটা নিয়েছি, অর্থাৎ যাতে চাকরিটা বাড়তি ঝামেলা না মনে হয়, সেটাই আর হচ্ছেনা বাসা থেকে কলেজের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে। যাত্রার সময় বেশি প্রস্তুতি লাগে, যাওয়া আসায় সময় নষ্ট হয়/ মা'এর আর ভালো লাগছিলোনা। ১৯৯৬ সালে বাবার অবসর গ্রহণের পর আমরা আমাদের রামপুরায় আমাদের নিজেদের বাসায় চলে আসি। এখানে আসার পর যাতায়াতে দূরত্ব আরো বেড়ে যায়, তার উপর রাস্তাঘাটে ট্রাফিক জ্যামের জন্য সময় লাগতে থাকে অনেক বেশি। তার উপর বয়সও বাড়ছে। সব মিলিয়ে মা চাকরিতে উৎসাহ রাড়াতেন থাকেন। তারপর একদিন সিদ্ধান্ত নিয়েই নেন স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার। ১৯৯৯ সালেই একদিন মা তার চাকরি জীবনের ইতি টানেন। কিন্তু সাথে নিয়ে যান একরাশ স্মৃতি এবং অনেক সন্তুষ্টি।
ষষ্ঠ পর্ব : মায়ের সংসার জীবন
সংসার জীবন নিয়ে কিছু না বললে মায়ের জীবন কথা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আবার এটাও সত্য যে মায়ের সংসার জীবন নিয়ে বইয়ের পর বই লিখে গেলেও সেই বই আমি লিখে শেষ করতে পারবো না। তাই অল্প কিছুই বলি এইবার। কোনো সময় হয়তো আবার কিছু লিখে যেতে পারবো।
বাবা-মায়ের বিয়ে হয় ১৯৬৩ সালে। বাবা তারও বছর দুই আগে থেকে রেডিওতে চাকরি করছেন। মতিঝিল এজিবি কলোনিতে একটা বাসায় বিয়ের পরে ওঠার কথা। ওই সময়টাতেই আমার ফুপাতো ভাই সেতারশিল্পী ইয়াসিন খানের সন্তান হওয়ার সময়। তাদেরকে বাবা বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত ওই সময়টাতে ওই বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই বাসর রাতটি আমার বড় চাচা সেতারশিল্পী ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা হয়। উনিও ওই কলোনিতেই থাকতেন। উনার পাঁচ ছেলেমেয়েরই তখন জন্ম হয়ে গেছে। বিরাট সংসার। সেখানেই একটা ঘর ছেড়ে দেন ছোট ভাইয়ের জন্য। বাবা মা নিশ্চয় অনেক ক্লান্ত ছিলেন। তাই জানতেন না যে মায়ের শ্বশুর মানে আমার দাদাও চলে এসেছিলেন সেই বাড়িতে রাতের বেলায়। নিজে এতো বড় মানুষ আমার দাদা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, কিন্ত একেবারে মাটির মানুষ। ছেলের যাতে ঘুমের অসুবিধা না হয়, সেইজন্য বাসার সামনের বারান্দাতেই মশারি খাটিয়ে রাতটা পার করে দিয়েছিলেন। সকালে উঠে মা-বাবার সেকি লজ্জার মধ্যে পড়ে যাওয়া। এগুলি সবই পরে হয়ে গেছে মধুর স্মৃতি।
আগের অধ্যায়গুলো লিখেছি মূলতঃ মায়ের মুখ থেকে ঘটনাগুলি শুনে শুনে। এই অংশের অনেক জায়গায়ই আমি নিজেই আছি, তাই এগুলি আমার নিজেরই স্মৃতির অংশ। সন্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে মা'কে দেখা। মা'কে আমরা পেয়েছি প্রতিটা দিন। অনেক সময় ভাবি সেটা কিভাবে সম্ভব? মা গান করতেন, কলেজে চাকরি করতেন। আবার প্রতিটা দিন সবসময়ই তাকে পেতাম। আসলে মা'এর চিন্তাভাবনাটা সবসময়ই ছিল পরিকল্পনামাফিক। সবসময় চিন্তা করতেন যে এমনভাবে সব কিছু যেন করতে পারেন যে প্রতিটা দিন যেন ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনের সময় তাকে কাছে পান। তিনি চিন্তা করতেন যে একটা দিনও যদি আমি তাদের কাছে না থাকি, আর সেই দিনটাতেই যদি আল্লাহ না করুক কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে তো তখন নিজেকে দোষ দিয়েও শান্তি পাওয়া যাবে না। আমি নিজেও অনেকটা সেভাবেই চিন্তা করি, তাই হয়তো আমি মায়ের চিন্তাধারাটা কিছুটা বুঝতে পারি।
মা আমাদের প্রয়োজনগুলিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তার পরেই নিজের প্ল্যানগুলি করতেন। হয়তো মা রেডিওতে গান গাইতে যাবেন, সেটা এমন সময়ে যখন আমরা স্কুলে। তাই আমরা বুঝতেও পারতাম না কখন উনি কাজটা শেষ করে এসেছেন। রেডিও বা টিভিতে গান করতে যাওয়ার সময়গুলো আমাদের ভাইবোনদের নিত্যকার কাজগুলির সাথে তেমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতোনা। আবার অনেক সময় মা আমাদের সাথে নিয়ে যেতেন। যেমন একবার ছায়াছবিতে প্লেব্যাক গান রেকর্ডিং-এর সময় আমার এক বছর বয়সী বড়ো বোনকে কোলে করেই রেকর্ডিংটা করেছিলেন। বড় হয়েও অনেকবার গেছি এবং সেটা আমাদের জন্য আরো আনন্দময় ছিল। এরকম অনেক অনেক ঘটনা আছে।
এছাড়া আগেই উল্লেখ করেছি মায়ের নাইট কলেজে চাকরিটা নেয়ার একটা বড় উদ্দেশ্যই ছিল যেন সংসারের নিত্যকার কাজের সাথে তার চাকরির সময়ের সংঘর্ষ না বাঁধে। প্রথমত ওই সময় আমরা তিন ভাই বোনই মোটামুটি বড় হয়ে উঠেছি, নিজেদের কাজগুলা নিজেরা গুছিয়ে করতে পারি, আবার মায়ের কলেজে যাওয়ার সময় সন্ধ্যাবেলাটায় আমরা মূলত পড়ালেখাতেই ব্যস্ত থাকতাম। এর মধ্যেই মায়ের কলেজের ক্লাস নিয়ে আসা হয়ে যেত। তাই বলতে পারি মা এমনভাবেই সময়গুলো বেছে বেছে উনার গান বা চাকরিগুলো করেছেন যে আমরা সবসময়ই মা'কে কাছে পেয়েছি।
আবার এমন না যে গান বা চাকরি না করলেও হতো। মা সবসময়ই বলেন এই যে গান বা চাকরি করে যে টাকাগুলি উনি উপার্জন করেছেন, সেগুলি সবই তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন বলেই যখন বাবার চাকরির শেষদিকে আমরা যখন নিজেদের বাড়ি বানানোর কাজে হাত দেই তখন বাবা-মা'র মিলিত উপার্জনের টাকা দিয়েই বাড়িটা সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়। সেই বাড়িতেই আমরা ১৯৯৬ সালে উঠে যাই, এবং বাবা ২০১৯ সালে তার শেষদিনটি পর্যন্ত সেখানে কাটিয়েছেন, এবং মা'ও সেখানেই শেষ দিনটি পর্যন্ত থাকতে চেয়েছেন।
ছোট্টবেলার কিছু ঘটনা দিয়ে শুরু করি। প্রায় পাঁচ মাস বয়স যখন আমার, তখনই আমার প্রথম ছবি তোলা হয়। মায়ের কোলে যেই দুটি ছবি আছে, সেগুলি আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলির অন্যতম। (ছবি)।
ছোটবেলায় কোন সময়টাতে থেকে নিজে নিজে খেতে শিখেছি, সেটা এখন আর মনে নেই, তবে কখনও শরীর খারাপ করলে, বা তাড়াতাড়ি খাওয়াটা শেষ করার প্রয়োজন হলে মা নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। আমি টেবিলে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম। মা একবার একবার করে মুখে তুলে দিতেন। মাংস বা মাছের তরকারি আর সাথে আলু থাকলে মা একবার লোকমায় মাংস আরেকবার লোকমায় আলু, এইভাবে হিসেবে করে মুখে তুলে দিতেন।
ছোটবেলায় মায়ের কাছেই পড়তাম। সন্ধ্যাবেলার মাগরিবের পর থেকে পড়তে বসাটা ছিলো একটা রুটিনের মতো। সেই সময় বিটিভিতে আটটার সময় সংবাদ পরিবেশন হতো। সেটা আমরা সবাই মিলে দেখতাম। ওই সময়টা আমাদের রাতের ডিনারেরও সময়। তাই আমাদের পড়ার সময়টা বেঁধে রাখা হয়েছিল মাগরিব থেকে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত। মজার ব্যাপার ঋতুভেদে এই সময় বদলাতোনা। তাই গরমকালে যখন সাতটায় মাগরিব হতো, তখন খুব মজা, এক ঘন্টা পড়লেই শেষ। আবার শীতকালে যখন পাঁচটায় মাগরিব হতো, তখন টানা তিন ঘন্টা পড়াটা যথেষ্ট কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু মায়ের কাছে নিয়ম হলো নিয়ম।
মা নিজেও কিন্তু কড়া নিয়মের মানুষ। সারা জীবন প্রতিটা দিন ঠিক ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠেছেন। যেকোন পরিপ্রেক্ষিতেই এইটা কখনো পরিবর্তন হয়নি। সকালে ওঠার জন্যই মা সকাল সকাল ঘুমিয়েও পড়তেন। আমরা শৈশবের কোনো সময়েই মা'কে রাত দশটার পর কখনো জেগে থাকতে দেখিনি। আমার মনে আছে মা বলেছিলেন, উনারা যখন ছোট ছিলেন, তখন সক্কাল বেলা নানা মায়েদের ঘুম থেকে উঠানোর দায়িত্ব পালন করতেন। মা আর বড়খালা ফরিদা ইয়াসমিন একই ঘরে থাকতেন। নানা দুই মশারির পাশ দিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক হাঁটতেন, আর আস্তে আস্তে বলতে থাকতেন, আর্লি টু বেড এন্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস ইউ হেলথি এন্ড ওয়াইজ। সেই বাণী হয়তো তখনই মা'র মনে গেঁথে গেছে। সেটার কোনোদিনই ব্যত্যয় হয়নি।
স্কুলজীবনে প্রতিদিন বাবার অফিস যাওয়ার আগেই মা আমাদের সবার জন্য নাস্তা রেডি করে দিতেন। অনেক সময় আমরা সবাই এক সাথেই বেরিয়ে যেতাম। আবার কখনো এমন স্কুলে পড়েছি, যখন আমাদের কারো কারো যাওয়ার সময়টা ভিন্ন। তখন আমাদের ভাইবোনদের আলাদা আলাদাভাবে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি করিয়ে দেয়া এগুলি সবই মায়ের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের অংশ। ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠার দরুন মায়ের কাছে দিনটা থাকতো অনেক বড়। সকালে আমরা স্কুলে বা বাবা অফিসে যাওয়ার আগেই হয়তো মায়ের রান্নাবান্না বা অন্যান্য অনেক প্রাত্যহিক কাজ শেষ। তাই আমরা বেরিয়ে গেলে একটু রিলাক্স সময় কাটাতে পারতেন। আমার বেশ ছোটবেলায়, বাবা এবং আমরা স্কুলে চলে গেলে, মা গলা সাধতে বসতেন। এটাও একটা সময় ছিল মায়ের রুটিনেরই অংশ।
দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস মায়ের কোনোদিন ছিলোনা। তবে খাওয়া এবং জোহরের নামাজের পর মিনিট পনেরোর মতো একটু শোয়ার অভ্যাস সবসময় ছিলো। মা বলতেন এটা না হলে বিকালের সময়টা থেকেই তার ঘুম ধরে যায়। আর এই পনেরো মিনিটের একটু ঝিম ধরা শুয়ে থাকাটা টনিকের মতো কাজ করে আর রাতে ঘুমানোর আগে কোনো বিশ্রামের প্রয়োজন পড়েনা। একদম রুটিন বেঁধে এই নিয়মেই প্রতিটা দিন পার করে গেছেন মা।
আমরা যখন বেশি ছোট ছিলাম, খুব বেশি ঘুরিনি আমরা। ওই সময়টা বাবা-মা'র সংসারও তখন স্থিতিশীল হয়নি, বেশ কয়েকবার বাসা বদল করতে হয়েছে। তার উপর '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার কমলাপুরে যে বাসাটায় ভাড়া থাকতাম, সেটা নিয়েও অনেক স্মৃতি। সেটা নিয়েই আলাদা একটা গল্প লেখা যায়। আমরা একটু বড় হওয়ার পর, যেমন বারো-চৌদ্দ হবার পর মা আমাদের নিয়ে বছরে একবার হলেও কোথাও ঘুরতে যেতে চেষ্টা করতেন। শীতকালের ছুটিতেই সাধারণত আমরা যেতাম। অনেক সময় কাজের ব্যস্ততার জন্য বাবা যেতে পারতেন না। মা তখন আমাদের নিয়ে যেতেন। বোনের বিয়ে একটু তাড়াতাড়িই হয়ে যায়। এরপর অনেক সময় আমাদের দুই ভাইকে নিয়েই যেতেন। রেডিওর চাকরির সুবাদে বাবার মোটামুটি দেশের সব জেলা শহরেই পরিচিত কেউ না কেউ ছিলো। তাই কোথাও গেলে সেখানে কেউ না কেউ আমাদের সমাদর করার জন্য প্রস্তুত থাকতো। আমাদের জন্য এটা ছিলো একটা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার। আবার মা পরিচিত শিল্পী হওয়ার দরুন অনেক সময় সেই শহরের রেডিওতে একটা গান করে দিয়ে আসতেন। এগুলি সবই মধুর স্মৃতি।
বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছিল রাজশাহীতে। এখানে মায়ের আদি নিবাস, তার নানাবাড়ি। তাই রাজশাহীর প্রতি মায়ের আলাদা টান ছিল। রাজশাহীতে মায়ের মনি মামা থাকতেন। উনার বিশাল বাসা, বিশাল পরিবার। সেখানেই এক ফাঁক ফোকর দিয়ে আমরাও ঢুকে গিয়ে কয়েকদিন থেকে আসতাম। এছাড়া খুলনা, চট্ট্রগাম যাওয়ার স্মৃতিও আছে। তবে সত্যিই একটা অবিস্মরণীয় সফর ছিল। ১৯৭৭ সালে বাবা অফিসের কাজে ইংল্যান্ডে যান। সেখানে ছয় মাসের একটা প্রজেক্টের কাজে ছিলেন। প্রথমে বাবা একই যান। তবে শেষ দুই মাস আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। এগারো বছরের আমার বড় বোন, আট বছরের আমি, এবং দুই বছর বয়সের আমার ছোট ভাইকে নিয়ে মা প্লেনে উঠেন। এতো বড় প্লেন যাত্রা আমার প্রথম। মনে আছে যাত্রার মধ্যে একবার আমাকে প্লেনের মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। আতংকিত মা চারিদিকে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। অবশেষে পাওয়া যায় আমাকে। কম্বল মুড়ি দিয়ে কোনার সিটের সামনে প্লেনের মেঝেতে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে ছিলাম। পরবর্তী দু'মাস আমাদের জীবনের অন্যতম সেরা অধ্যায়। প্রথমবারের মতো ইউরোপ দেখার সুযোগ পাই আমরা।
আমার নানা-নানী বেঁচে ছিলেন ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। সত্তর দশকের দিকে আমরা মাঝে মাঝেই নিয়মিত নানাবাড়ি যেতাম। আমরা নানা-নানীকে সবসময়ই দেখেছি আমার ছোটখালা সাবিনা ইয়াসমিনের সাথেই থাকতে। ছোটখালাই নানা-নানীকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সবচেয়ে প্রথমে আমরা গিয়েছি উনাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। ওই বাসার কথা আমার তেমন মনে নেই, তবে মনে পড়ে একটা সুন্দর টিভি ছিলো যেটা আবার একটা বাক্সের মধ্যে ঢুকানো থাকতো, আর সেই বাক্সের একটা দরজা ছিল সেটা স্লাইড করে খোলা বন্ধ করা যেত। এরপর আমরা যেতাম উনাদের পল্লবীর বাসায়। উঁচু পাঁচিল দেয়া বড় একতলা বাসাটার কথা আমার ভালো মনে আছে। ভিতরে ছিল বড় বাগান। ঢুকতেই গ্যারেজটা পার হলেই বিরাট ড্রইংরুম। রুমের পুরো একটা পাশ বাগানের দিকে খোলা। কি যে ভালো লাগতো ওই বাসায় গেলে। মা গিয়ে নানীর সাথে গল্প করতেন, রান্নাঘরে একসঙ্গে কাজ করতেন। আমরা খেলে বেড়াতাম। ছোট খালা সাবিনা ইয়াসমিনের মেয়ে বাঁধনকে পেতাম অনেক সময়। মজার মজার খেলনা থাকতো ওই বাসায়।
তবে সত্তর দশকের শেষেই উনারা কলাবাগানে চলে আসেন। এটাও একটা বাগানওলা একতলা বাসা। এখানে কিছুদিন থাকার পর উনারা লালমাটিয়া চলে যান। ততদিনে ছোটখালা নৃত্যশিল্পী আমীর হোসেন বাবুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তখন নানা-নানীকে লালমাটিয়ার একটি বাসায় আলাদাভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ছোট খালা কাছেই একটা বাসা নিয়ে নেন। এই বাসাটা খুব সম্ভব চারতলায় ছিল। ততদিনে আমরা বড় হয়ে যাচ্ছি, এবং আমাদের নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার হার কমে গেছে। বড়োজোর বছরে দুই ঈদে দুইবার যেতাম। ঈদের পরদিনটা সাধারণত নানাবাড়িতে মায়েরা বোনেরা একসঙ্গে দুপুরবেলায় মিলিত হতেন। আমরা খালাতো ভাইবোনেরাও সেখানে একে অন্যের দেখা পেতাম। ভালোই কাটতো দিনটা।
পঁচাশি সালে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। ওই দিনটিতে অন্যান্য অনেক ঘটনার মধ্যেও আমি খেয়াল করেছিলাম আমার নানী কি যে উচ্ছসিত ছিলেন সারাটা দিন। তবে এরপর নানী বেশিদিন ভালো থাকেননি। কয়েক মাস পরেই নানীর স্ট্রোক হয়, এবং কোমড়ের নিচের অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এরপর জীবনের বাকি তিনটা বছর উনি বিছানা থেকে আর উঠতে পারেননি। ওই সময় নানা-নানী শেষবারের মতো বাসা বদল করে লালমাটিয়ায় আরেকটি একতলা বাসায় চলে আসেন। ছোটোখালাই সব ব্যবস্থা করেন। উনি পাশেই একটা বাসায় থাকতেন। এই বাসায় থাকার সময় আমি একাই কয়েকবার নানীকে দেখতে গিয়েছি। ওই সময় আমি ঢাকা কলেজে পড়তাম। যাতায়াতের পথে আমি নানার বাসায় থামতাম। নানী গান পছন্দ করতেন। তাই ছোট একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে যেতাম। সাথে নিতাম কিছু উনার আমলের হিট গানের ক্যাসেট। বৈজু বাওরা, নাগিন। এগুলো উনাকে শোনাতাম। তেমন উপভোগ করছেন কিনা বুঝতাম না। কিন্তু শুনতেন চুপচাপ। নানাকে বেশিরভাগ সময়েই পেতাম বাগানে। একা একা বসে বসে কোন গাছের গোঁড়ায় মাটিটা একটু আলগিয়ে দিচ্ছেন হয়তো। সেই জোয়ান বয়সে নানা-নানি কত সংগ্রাম করেছেন, তার কিছুই বিশ্বাস হবেনা এই নানা-নানীকে দেখলে। এটাই জীবন।
এরপর ৮৯ সালে নানা হঠাৎ হার্ট এটাক করে কয়েকদিনের নোটিশে মারা যান। মায়ের সাথে হাসপাতালে আমরাও উনাকে শেষ দেখা দেখতে গেছিলাম। এরপর মাস ছয়েক পরে নানীও চলে যান। এইভাবেই মায়ের জীবন এবং আমাদের জীবন থেকে নানা-নানী বিদায় নেন।
মায়ের অন্যান্য শখের কথা বলি। মায়ের সেলাইয়ের শখ ছিল। ছোটবেলায় আমাদের শার্ট, প্যান্ট সবই মা নিজেই সেলাই করতে পছন্দ করতেন। আরো ভালো সেলাই করতে পারার জন্য মা সেলাইয়ের একটা কোর্সও করেছিলেন। এছাড়া মা ভালো সোয়েটার বুনতেন। ছোটবেলার সব সোয়েটারই সম্ভবত মায়ের হাতেই বানানো। আমি একসময় মায়ের কাছে বসে সোয়েটার বানানোর হাতেখড়ি নিয়েছিলাম। তবে বেশিদূর আগাতে পারিনি।
এছাড়া মায়ের রান্নার শখও ছিল। ঘরের রান্না তা করতে হয়ই, কিন্তু মা চাইতেন আরো কিছু করতে। বেকারি কনফেকশনারির দিকে মা'র ঝোঁক ছিল। এইজন্য সত্তর দশকের শেষ দিকে ধানমন্ডিতে একটা রান্নার ক্লাসে ভর্তি হয়ে যান। কোর্সটি শেষ করার পর মা এতটাই উৎসাহ পান, যে নিজেই একটা রান্নার ক্লাস খোলার সিদ্ধান্ত নেন। 'ঘরকন্যা' নাম দিয়ে সেই সেই ক্লাসও মা শুরু করেন ১৯৭৯ সালে। বাসাতেই সপ্তাহে একদিন বসতো সেই ক্লাস। সাড়াও পেয়েছিলেন অনেক। আশেপাশের প্রতিবেশীরা তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকেও অনেকেই এসে মায়ের কাছে রান্না শিখে গেছেন। সপ্তাহে যেই দিনটিতে ক্লাস হতো, সেই দিন আমাদের জন্য ঈদের দিনের মতো আনন্দের। কারণ আমরা জানতাম ক্লাস শেষ হলে যেই খাবারটা আজকে বানানো হয়েছে, সেটার অবশিষ্ট অংশটা আমরা পাবো। এরকম কত খাবার যে খেয়েছি এই ক্লাসটা যতদিন চালু ছিল ততদিন। নানখাতাই বিস্কুট আর বার্থডে কেকের দিন পেট ভরে এগুলি খেতাম। তবে আমার সবচেয়ে মজা লাগতো 'মাটন প্যান কেক'। মায়ের হাতে বানানো সেই মাটন প্যান কেকের স্বাদ আমার মুখে এখন লেগে আছে। দশ বছর টানা ক্লাস চালানোর পর ১৯৮৯ সালে মা নানা ব্যস্ততার কারণে ক্লাসটা বন্ধ করেন।
আমাদের তিনভাইবোনের জন্মদিন হলেই আমরা দুইটা জিনিস করতাম। বাবার শখ ছিল ছবি তোলা। তখন তো এখনকার মতো হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ছিলোনা। আমাদের একজন বাঁধা ফটোগ্রাফার ছিল। তার নাম সাচ্চু মিয়া। জন্মদিনের দিন তাকে ভাড়া করে আনা হতো। আমাদের ছোটবেলার জন্মদিনের যত ছবি আছে, সবই সাচ্চু মিয়ারই তোলা। মায়ের বানানো বার্থডে কেক কেটে আর খেয়েই বিকালটা কেটে যেতো। এরপর আমাদের দ্বিতীয় রুটিন ছিল চাইনিজ খাওয়া। আমরা চেষ্টা করতাম প্রতিটা জন্মদিনে একটা নতুন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া। এরকম ঢাকা শহরের কত যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমরা গেছি সেটার আর হিসাব নাই।
মা কোথাও বাইরে গেলে সবসময়ই ফিরটেন কিছু না কিছু মজার খাবার নিয়ে। তাই মা কোথাও বেরুলে আমরা অপেক্ষা করতাম আগ্রহ নিয়ে। বাসায় আমি থাকলে মা বাসার দরজায় এসে ডাক দিতেন 'রূপ'। আমার 'রূপক' নামটাকে ছোট করে এইভাবে আদর করে ডাকাটা কেবল মায়েরই।
ছোটবেলায় কলোনির জীবন ছিল শান্ত এবং কোলাহলমুক্ত। ছুটির দিনগুলোতে দুপুর ছিল অলস। আমি মায়ের সাথে ঘরের টুকটাক কাজ করতে পছন্দ করতাম। রান্নাঘরে মা যখন কাজ করতেন, আমিও সুযোগ পেলে থালা-বাসন একটু ধুয়ে দেয়া, এদিক সেদিক একটু পরিষ্কার করা বা গুছিয়ে রাখা এগুলি করতাম। দুপুরবেলায় বারান্দায় কাপড় শুকানো হয়ে গেলে, সেগুলি ভাজ করতে মা'কে সাহায্য করতাম। রোজা আসলে মজা হতো। আটার রুটি বানানোর আয়োজন হতো। অন্যান্য দিনও রুটি হতো, কিন্তু রোজার সময় বানাতে হতো অনেক বেশি। কারণ সেহেরীতে আমরা পাগলের মতো যত রুটি পারা যায় খেতাম। আমার উৎসাহ ছিল বেশি। আমি বেলন পিঁড়ি নিয়ে বসে রুটি বানানোর চেষ্টাও করতাম। বেশ কিছুদিন সাধ্যসাধনার পর রুটি গোল করে বানানো দক্ষতাও অর্জন করলাম। যেদিন প্রথম রুটি বেলার সময় রুটিটা ঘুরতে ঘুরতে গোল হয়ে গেলো সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে। এছাড়াও আমার অতি উৎসাহের কারণে মায়ের কাছে পরোটা বানানোও শিখলাম। প্রথমবার গোল করে রুটিটা বানানো। তারপর একটু তেল দিয়ে ভাজ করে চারকোনা বানানো। তারপর এই চারকোনাটাকেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেলতে বেলতে চারকোনা পরোটাতে পরিণত করা, সে এক বিশাল আনন্দের ব্যাপার।
নামাজ রোজার ব্যাপারে মা ছিলেন অত্যন্ত নিয়মিত। কোনোদিন আমি মা'কে কারণ ছাড়া নামাজ রোজা মিস করতে দেখিনি। আমাদেরও মা শিখিয়ে গেছেন ধর্মের পথে থাকতে। বারো বছর হওয়ার পর থেকেই আমি নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করি। সাত বছর বয়সে প্রথম রোজাটা রেখেছিলাম। এরপরের বছর রাখি সাতটা। তার পরের বার এগারোটা। দশ বছর বয়সে সতেরোটা। এগারোতে তেইশটা। আর বারো বছর বয়সে প্রথমবারের মতো সব ক'টি। তারপর থেকে শারীরিক কোনো অসুবিধা না থাকলে প্রতি বছর নিয়মিত সব রোজা রেখে গেছি আল্লাহর ইচ্ছায়। মা'কে দেখেই এই উৎসাহ। মা'ও নিয়মিত সব রোজা রেখে গেছেন সারাজীবন।
১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে আমাদের একটা বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় চলে আসে। বাবার আসন্ন রিটায়ারমেন্টের আর তখন ছয় সাত বছর বাকি। আমার বড় চাচা ততদিনে রিটায়ারমেন্ট চলে গেছেন। রিটায়ারমেন্ট যাবার আগেই উনি আমাদের দাদার রামপুরার জমিটাতে নিজের বাসাটা তৈরী করে ফেলেছিলেন। চাকরির শেষ বছরটাতে কলোনি ছেড়ে ওই বাসাতেই উঠে যান তিনি কাজটা নিজের হাতে করার জন্য। এরপর আসে ৮৮-এর বন্যা। ঢাকা শহরে খুব কম জায়গাই ছিলো যেখানে বন্যার পানি ওঠেনি। তার মধ্যে একটা ছিলো আমাদের রামপুরার জমিটা। বন্যার পরপরই চাচা বাবাকে উৎসাহ দেন আমাদের বাড়ির কাজটাও শুরু করে ফেলতে। বাবা-মা প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন। কারণ সরকারি লোন নিয়ে কাজটা করতে চাননি তারা। সারাজীবন ঋণ-ধার থেকে সতর্কভাবে দূরে ছিলেন উনারা। একটা পয়সাও কখনো ধার করতে দেখিনি তাদেরকে। কিন্তু বাড়ি বানানো একটা বিশাল ব্যাপার। প্রচুর টাকার ব্যাপার। অত টাকা কিভাবে জোগাড় করা যাবে সেই চিন্তা মাথায় এসে গেলো। আবার অবসরের পর একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই লাগবে সেটাও তো সত্য। তখনই মা বসে গেলেন তার জীবনের যত সঞ্চয় আছে সেটার হিসেবে মিলাতে। সারা জীবনের গান গাওয়ায় উপার্জন, কলেজ জীবনের উপার্জন, এগুলো কিছুই খরচ করেননি মা। দুর্দিনে যাতে এগুলো কাজে আসে এই আশায়। তাহলে তো এটাই উপযুক্ত সময় টাকাগুলো কাজে লাগানোর জন্য। বাবার নামে একটা সরকারি জমি বরাদ্দ ছিল মিরপুরে। সেখানে আর বাড়ি বানানোর কথা না চিন্তা করে বড় ভাইয়ের পাশাপাশিই নিজের বাবার জমিতে বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেনা বাবা। সাথে মা'কেও পেলেন। দুই ভাই কলোনীতেও জীবনটা পাশাপাশি কাটিয়েছেন। আবার অবসরের পরেও একসাথে থাকবেন। এরকমই চিন্তা ভাবনা। মিরপুরের জমিটা বিক্রির ব্যবস্থা হলো। সাথে যুক্ত হলো মায়ের জমানো টাকা। বিসমিল্লাহ বলে শুরু হয়ে গেলো আমাদের বাড়ি তৈরীর কাজ।
১৯৮৯ সালে শেষ হয় একতলা। সেরকমই ছিলও পরবর্তী তিন বছর। এরপর ৯২-৯৩ সালে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলার কাজ শেষ হয়। ৯৫ সালে চতুর্থ তলার কাজটাও শেষ হয়ে যায়। এই সময়টায় আমি পুরোপুরি জড়িত ছিলাম বাসা তৈরির কাজে। প্রতিদিন কাজের দেখাশোনার ভার ছিল আমার হাতে। এইভাবে পরিকল্পনামাফিক আমাদের চারতলা বাসার কাজ শেষ হয়ে যায় বাবার অবসর গ্রহণের ঠিক আগে আগে। একটা টাকাও কোথাও থেকে ঋণ করতে হয়নি। সম্পূর্ণ নিজেদের টাকায় পুরো বাড়িটা সম্পূর্ণ করার পর বাবা-মা'কে স্বস্তির নিঃশাস ফেলতে দেখেছি।
এই বাড়িতেই আমরা উঠে যাই ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবার চাকরি জীবন শেষ হওয়ার পরপর। প্রথম থেকেই বাবা-মা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন চারটা তলা সুন্দরভাবে বিভক্ত করার। সেই মোতাবেক নীচতলাটা উনাদের নামে, দ্বিতীয় তলা আমার ছোটভাইয়ের নামে, তৃতীয় তলাটা আমার বোনের নামে এবং চতুর্থতলাটা আমার নামে হেবা দলিল করে ফেলা হয়। ২০০৪ সালে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত আমি চতুর্থ তলাতেই থাকতাম। আমার প্রথম সন্তান তানিশার জন্ম হয় এখানেই। মা-বাবার নানী-নাতনিদের মধ্যে একমাত্র তানিশারই জন্ম এই রামপুরার বাসায়। সব কিছু মিলিয়ে মায়ের সাথে সাথে আমদের সবারই রামপুরার বাসার একটা বিশাল ঘনিষ্টতা হয়ে গেছে।
রামপুরায় নিজেদের বাসায় ওঠার পর মা হয়ে ওঠেন এই বাড়ির ম্যানেজার। বাড়ির প্রতিটা কাজ প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে মা করে যেতেন। যে কোন খুঁটিনাটি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপার, মেরামতির কাজ, উপযুক্ত ভাড়াটিয়া খোঁজা, ভাড়াটিয়াদের পানির ব্যবস্থাপনা, এগুলি সবই চলতো মায়ের দায়িত্বে। শৃঙ্খলার সাথে নিজের জীবন কাটিয়ে গেছেন, বাড়িটাকেও একইভাবে শৃঙ্খলার সাথে দেখাশোনা করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। মা প্রতিটা দিন কর্মব্যস্ততায় কাটাতে চান। এটি তার চরিত্রেরই অংশ। নিজেদের বাড়িতে ওঠার পর প্রতিটা দিন বাড়ির বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকাটাই মা-কে উজ্জীবিত রেখেছে। কর্মব্যস্ততাই মায়ের জীবনের চলার একটা পাথেয়।
আমার বোনের বিয়ে হয়ে যায় খুব অল্প বয়সে। তখন আমার বোন অনার্স পড়ছেন। আমার বোন পড়ালেখায় অসম্ভব ভালো। ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েটে হোম-ইকোনমিকসে ঢাকা বোর্ডে প্রথম হয়েছিলেন। তাই অনার্সের রেজাল্ট ভালো করার একটা তাগিদ ছিলো। আর এর মধ্যেই বিয়ে হয়ে যাওয়াতে পড়ালেখাটা কিছুটা হলেও হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছিলো। তার উপর বিয়ের বছরখানেক গড়াতে না গড়াতেই সন্তানের মা হয়ে যান আমার বোন। এই সময় বাবা এবং মা অনেক দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেন। যাতায়াতের সুবিধার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা, থাকার জন্য অফিসের কোয়ার্টারের ব্যবস্থা ইত্যাদি বাবা করে দেন। আর মা সাংসারিক দায়িত্বগুলি পুরাপুরি হাতে নিয়ে আমার বোনকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে দেন যাতে সে পড়ালেখাটা সুন্দরভাবে চালিয়ে যেতে পারে। সকাল সকাল আমার বোন তার বাসা থেকে আমার ভাগ্নেকে নিয়ে চলে আসতেন আমাদের বাসায়। এখানে নাস্তা করে বাবার সাথে আমার বোন চলে যেতেন কলেজে। আমার ভাগ্নে থেকে যেতো তার নানীর কাছে, মানে মায়ের কাছে। সারা দিন আমার ভাগ্নেকে নিজের সন্তান যেভাবে মানুষ করে সেভাবেই আমার মা তার পরিচর্যা করে যেতেন। তাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো এগুলো তো আছেই। এ ছাড়াও রান্নাবান্না করা, কাপড় ধোয়া, সেগুলি রোদে দেয়া, শুকানো, গুছানো, এগুলো করতে করতেই দিন কেটে যেত। বিকালে বোন আসতেন কলেজ থেকে। তারপর আরেকটু সময় বাসায় কাটিয়ে রাতে খেয়ে তারপর বোন ভাগ্নেকে নিয়ে চলে যেতেন তার বাসায়। আবার রাতটা পার করে পরের দিন আবার সকালে আমাদের বাসায়। এই ছিল সেই সময়কার রুটিন। এভাবে দিনের পর দিন চলে গেছে। আমার ভাগ্নে মোটামুটি আমাদের বাসাতেই আমাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হয়েছে যখন আমার বোন অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে, তারপর মাস্টার্সেও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। এরপর বিসিএস পরীক্ষায় তার বিভাগে প্রথম হয়ে হোমইকোনোমিক্স কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে এখনও সেখানেই অধ্যাপনা করে যাচ্ছেন।
বাবার সেবায় বাবার জীবনের শেষ নয়টি বছর মা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সেটার উল্লেখ না করলে মায়ের সংসার জীবনের কথা বলা সম্পূর্ণ হবেনা। ২০১০ সালে বাবা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েন। এতে তার বাঁ পায়ের কোমরের অংশ দুর্বল হয়ে যায়। মা এবং আমার বোনের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে কিছুটা সুস্থ হয়ে প্রথমে ক্র্যাচ, এবং পরে ওয়াকারের সাহায্যে বাবা চলাফেরা চালান। পরের বছর একটা বড় হার্ট এটাক হয়ে যায় বাবার। এবারো মা এবং বোনের সহায়তায় ধাক্কা সামলে ওঠেন বাবা। কিন্তু অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। এরপর বছর দুয়েক কষ্ট করে হলেও নিজস্ব কার্জকলাপগুলি চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাবা। যেমন লেখালেখির কাজটা, বা কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া বা কোনো সাক্ষাৎকার দেয়া ইত্যাদি। তবে বোঝা যাচ্ছিলো বাবার স্মৃতিশক্তি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। ডিমেনশিয়ার লক্ষণগুলো পরিষ্কার হচ্ছিলো। আসলে বাবা আলঝাইমারে আক্রান্ত হয়ে গেছিলেন। ধাপে ধাপে সেটাই আরো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিলো। শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই হয়ে যাচ্ছিলেন পরনির্ভরশীল। বোন চাকরি করেন। চাকরির সময়টুকু বাদে অন্য সময়টা বাবার জন্য বিভিন্নভাবে ব্যয় করতেন। আর সারাদিন সার্বক্ষণিকভাবে বাবার তত্ত্বাবধানে ছিলেন মা। কোন কাজটা না করে দিতেন তিনি। প্রতিবেলায় খাবার খাওয়া, গোসলের ব্যবস্থা, মলমুত্র ত্যাগ প্রতিটা কাজে বাবার অন্যের সহায়তা লাগতো। মা-ই ছিলেন সবসময় তার পাশে। আলঝাইমারের শেষ ধাপে ২০১৯ সালে বাবা বিছানায় পড়ে যান। সেই অবস্থায় ছিলেন প্রায় দেড় মাস। এই সময় শুধু খাওয়ানোর জন্য বাবাকে শোয়া অবস্থা থেকে কোনোমতে একটু বসার মতো করে তারপর খাইয়ে দেয়া, এই কঠোর পরিশ্রমের কাজ মা এই বয়সেও একা হাতে করে গেছেন দিনের পর দিন।
এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে বাবা চলে যান। বাবার পিছনে এতো অমানবিক পরিশ্রম মা করে গেছেন বছরের পর বছর । তারপরও শেষ দিনটা যে একরকম অকস্মাৎভাবেই এসে যাবে সেটা বোধহয় মা ধারণাই করতে পারেননি। প্রতিদিনকার মতোই বাবার ঘুমাবার ব্যবস্থা করেছিলেন মা। বাবার কিছু অস্বস্তি হচ্ছিলো। মা জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে? বাবা উত্তর দিলেন, পানি খাবো। মা পানি নিয়ে এলেন। বাবাকে যেন কষ্ট করে উঠতে না হয় সেজন্য চামচে করে দু'বার পানি খাইয়ে দিলেন। এরপর ঘুমাতে বললেন। কিন্তু বাবার অস্বস্তি যেন কাটছিলোনা। সে কারণে ঘুমিয়ে পড়লেও মায়ের ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতের কিছু পরে। টর্চ জ্বালিয়ে বাবাকে খেয়াল করলেন কিছুক্ষন। খানিক অস্থিরতার পর বাবা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলেন। মা'ও বাকি রাতটা ঘুমিয়ে সকাল সকাল উঠে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরের কিছু কাজ সেরে নিলেন। বাবার এতো সকালে না উঠলেও চলে। নয়টার পরপর সকালের নাস্তা রেডি করে বাবাকে ডাকতে গেলেন। সাধারণত মুখের ডাকেই বাবা সাড়া দেন। কিন্তু সেদিন সাড়া আসলো না। বাবার গায়ে হাত দিয়ে মা দেখলেন বাবার শরীর শীতল হয়ে গেছে। মা বুঝে গেলেন বাবা এই জগৎ ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দিয়েছেন। তারিখটা ছিল ২৪শে নভেম্বর, ২০১৯। সুদীর্ঘ ৫৬ বছরের জীবনসাথীকে হারিয়ে এক বিশাল শূন্যতার মধ্যে পড়ে যান মা। পাশে আমার বোন সবসময় ছিলেন, এখনও আছেন। সারাদিন কাজ শেষ করে রাতে মায়ের পাশেই শুয়ে ঘুমান। এভাবেই চলে যাচ্ছে মা-মেয়ের সংসার।